ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : বাঙালির ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের একটি উজ্জ্বলতম দিন। প্রকৃত অর্থে এ দিনই আসলে লাখো জনতার সামনে তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মুক্তিকামী বাঙালির সামনে বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসেরই নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছিলেন। অথচ এ ঐতিহাসিক ভাষণের সময়কাল ছিল মাত্র ১৭-১৮ মিনিট। মাত্র ১৭-১৮ মিনিটের একটি ভাষণের যে এত মাধুর্য থাকতে পারে, তা যতই দিন যাচ্ছে ততই বিশ্বের মানুষের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম অর্থাৎ এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাঙালিকে প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সেদিনের ভাষণে বলেছিলেন, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি..., যার যা কিছু আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে অর্থাৎ এর মাধ্যমে যে তিনি দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথাই বলেছেন, তা আর কাউকে সেদিন পরিষ্কার করে বলে বোঝাতে হয়নি।
সেদিন রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে শত্রু মনে করলেও তিনি তখনো এ দেশে যেসব পাকিস্তানিরা চাকরির জন্য অবস্থান করছিল তাদের শত্রু মনে করেননি। কারণ তিনি সেদিনের ভাষণের একাংশে বলেছিলেন, তোমরা আমার ভাই, তোমরা আমার বন্ধু..., অর্থাৎ পাকিস্তানিরা যদি স্বেচ্ছায় বাংলার স্বাধীনতা মেনে নিয়ে তারা এ দেশ ছেড়ে চলে যায়, তবে এ বাংলার মানুষ তাদের বন্ধুসম মনে করবে। অপরদিকে এ দেশ না ছাড়লে আবার এমন হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন যে, তোমাদের পানিতে মারব, ভাতে মারব...ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরে তিনি নির্ধারিত করে দিয়ে বলেছিলেন, এ দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, সংগ্রামের সময়, হরতালের সময়, অসহযোগের সময় কী কী চলবে আর কী কী চলবে না। অর্থাৎ খাবারের গাড়ি চলবে, ওষুধের গাড়ি চলবে, হাসপাতাল চলবে, আবার রেলগাড়ি চলবে না, কোর্ট-কাচারি বসবে না, অফিস-আদালত চলবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এ ভাষণের মাধ্যমে সুদীর্ঘকাল ধরে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন তথা সুকৌশলে একটি মুক্তিযুদ্ধের কথাই বলা হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এ ভাষণকে বিগত ২৫০০ বছরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সেজন্য এ ভাষণকে ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ইতিহাসে হঠাৎ করে এমন একটি দিন এসে উপস্থিত হয়নি। এ রকম একটি দিনের জন্য বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এর জন্য প্রথম ধাপের সফলতাটি ছিল ১৯৪৮ সাল থেকে চলে আসা বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন। দীর্ঘ প্রায় চার বছর আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯৫২ সালে সেটি পরিণতি লাভ করে শেষ পর্যন্ত তা আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু তার জন্য যথারীতি রাজপথে দিতে হয়েছিল অনেক রক্ত। তার পরের প্রতিটি ইতিহাসই বাঙালি মাত্রেই জানার কথা।
আর যাঁরা ইতিহাস জানেন না কিংবা চর্চা করেন না বা করলেও প্রকৃত ইতিহাসটি সামনে আনতে চান না, তাঁদেরকে বর্তমানে সত্যিকারের ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে এগুলো জেনে নিতে হবে। কারণ ইতিহাসের কখনো মৃত্যু হয় না, কিংবা প্রকৃত ইতিহাস সময়ের ফেরে বিকৃত হলেও তা কখনো চেপে রাখা যায় না। এ কথাগুলো বলা হচ্ছে এ কারণে যে, স্বাধীনতার সাড়ে চার দশকেও এখনো বাঙালির স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির কথা শোনা যায় যা খুবই দুঃখজনক। সেই ৭ মার্চের প্রেক্ষাপট তৈরিতে কীভাবে সময়ে সময়ে দেশ-জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন ইস্যুতে গর্জে উঠেছে তার কিছু ইতিহাস এখানে বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। ভাষার জন্য আন্দোলন, স্বৈরাচারী সামরিক শাসনবিরোধী অন্দোলন, শিক্ষার জন্য আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, স্বাধিকারের আন্দোলন, সর্বোপরি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ইত্যাদি সবই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য পেক্ষাপট তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। তার আগে ১৯২০-২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ১৯৩৫ সাল থেকে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বিভিন্ন অধিকার আদায়ের আন্দোলন, তারপর ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং ১৯৪৪-৪৫ সালের পর থেকে একেবারে সক্রিয়ভাবে তৎকালীন যুবক শেখ মুজিব আস্তে আস্তে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে শরিক হয়ে একাকার হয়ে যেতে থাকেন।
সেই থেকেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন অবধি তিনি দেশ ও জাতির কোনো কিছুরই বাইরে থাকেননি। এ জন্য তিনি যে কতবার কারাবরণ করেছেন তার সঠিক হিসাব বের করা কঠিন। কাজেই তিনি প্রতিটি আন্দোলনের প্রতিটি ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বিধায় নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি দিয়েই তিনি ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিতে পেরেছিলেন। কারণ এটি ছিল বাঙালির মুক্তির দিক-নির্দেশনামূলক বজ্রকণ্ঠ। তারই প্রেক্ষাপটে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের পর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে দুটি ছাড়া বাদবাকি ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন আওয়ামী লীগ পেয়ে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের দুটি কক্ষেই অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সরকার গঠনের জন্য পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সমর্থ হয়। এর পর থেকেই শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের টালবাহানা। রেওয়াজ অনুয়ায়ী নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ট দলকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে। সেই সঙ্গে পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকে সরকার ও পার্লামেন্টের আরো কিছু জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। নির্বাচন হয়ে বেশ কিছুদিন চলে গেলেও যখন এ সম্পর্কিত কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছিল না, তখন বঙ্গবন্ধুর চাপে তারা ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হয়।
কিন্তু প্রকৃত অর্থে সেটিও ছিল তাদের একটি অপকৌশল মাত্র। পরে ঘটনা পরম্পরায় মিলিয়ে দেখলে যা সহজেই বোঝা যায় সেটি হচ্ছে, একদিকে তারা পার্লামেন্ট মিটিংয়ে বাঙালিকে প্রস্তুতি নেওয়ার আড়ালে তাদের ছিল অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলার পরিকল্পনা। সে মোতাবেক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে সৈন্য-সামন্ত ও গোলাবারুদ এসে এ দেশে জড়ো হতে থাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে। ইচ্ছা করলে তিনি পুরো পাকিস্তানের দুই কক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আগেভাগেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে পারতেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এতে লাভের চেয়ে ক্ষতিই হতো বেশি। কারণ তখন ভারতকে বাংলাদেশের মিত্র হিসেবে না পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা ছাড়া বাংলাদেশ আগে আক্রমণ করলে বিশ্বজনমত পাকিস্তানের পক্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তখন পাকিস্তান এবং তার মিত্ররা পূর্ব বাংলার আন্দোলনকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে চালিয়ে সেটার বেনিফিট তারা পেয়ে যেত। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য এখানেই যে, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন দূরদর্শী নেতা আমাদের দেশমাতৃকার নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি সেগুলো আগে থেকেই বুঝতে পেরে ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, নবীণ, প্রবীণ ও তাঁর অনুগত সেনা, নৌ, বিমানবাহিনীর সদস্যদের গ্রিন সিগনাল দিয়ে রেখেছিলেন। তিনি আমাদের মিত্র ও প্রতিবেশী হিসেবে ভারতেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। তৎকালীন ডাকসুর নেতারা বিশেষ করে চার খলিফাখ্যাত ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব, জিএস আবদুল কুদ্দুছ মাখন, ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ প্রমুখকে ডেকে বঙ্গবন্ধু কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশনা দেন। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, সে সময় কামরুল আলম খান খসরু, বেগম মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু প্রমুখ ছাত্র নেতারাও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও নিউক্লিয়াসের সক্রিয় সদস্য হিসেবে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
আর তোফায়েল আহমেদ তো তখন সবকিছুর সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। যা হোক, ৩ মার্চের পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হওয়ার খবর আসার পর বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত হরতাল, অবরোধ এবং অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে অতিবাহিত হতে থাকে দেশ। এরই মাঝে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আ স ম রবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে সারা দেশে পুরো মার্চ মাসজুড়েই লাল সবুজের বাঙালির জাতীয় পতাকা উড়তে থাকে। পহেলা মার্চেই যখন দেখা গেল পার্লামেন্টের অধিবেশন স্থগিত হয়ে গেল, তখনই রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চে গণসমাবেশ ডাকা হয়। ইতিহাসে তা-ই আসলে ৭ মার্চের জনসভা এবং সে সভায় দেওয়া ভাষণই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের বিশ্বখ্যাত ভাষণ। সেই ভাষণের সূত্র ধরেই স্বাধীনতার ঘোষণা, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা, ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়া, অতঃপর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশের ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং দুই লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এখনো এ দেশে পূর্বে ফয়সালা হয়ে যাওয়া এটা-ওটা নিয়ে নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকে। তাহলে কবে পাব আমরা এ দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার স্বাদ?
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়