সাক্ষাৎকার
একুশে ফেব্রুয়ারি গাছ বেয়ে দেয়াল পেরোই : শরিফা খাতুন
ভাষাসৈনিক অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন ভাষা আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন। বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রচারণা চালান। স্কুলের ছাত্রীদের সংগঠিত করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজ প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেয়াল টপকে চলে আসেন আমতলায়, অমান্য করেন ১৪৪ ধারা।
ড. শরিফা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগ থেকে ১৯৫৬ সালে অনার্স ও ১৯৫৭ সালে মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৫৮ সালে শিক্ষকতায় যোগ দেন। পরে বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কলারাডো স্টেট কলেজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন ১৯৬৮ সালে। দেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। অবসরে যান ২০০২ সালে। তাঁর ৪১টি গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো : মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা, তুলনামূলক শিক্ষাতত্ত্ব (২ খণ্ড), লিবারটেরিয়ান শিক্ষার পথিকৃৎ আলেকজান্ডার নীল, অস্তিত্ববাদ ও শিক্ষা, Development of Primary Education Policy in Bangladesh প্রভৃতি। শরিফা খাতুনের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাশার খান।
বাশার খান : আপনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আজকে আমরা আপনার সঙ্গে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কথা বলব। শুরুতে আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়া সম্পর্কে জানতে চাই।
শরিফা খাতুন : আমার জন্ম ১৯৩৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। তৎকালীন ফেনী মহকুমায় শশ্মদি ইউনিয়নের জাহানপুর গ্রামে। অবশ্য আমার জন্মের আগে থেকেই আমার বাবা-মা আসামে থাকতেন। বাবা আসামের রেলওয়েতে চাকরি করতেন। আমার জন্মের সময় বাবা-মা গ্রামে আসেন এবং সেখানেই আমার জন্ম হয়। পাঁচ বছর পর্যন্ত আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে আসামেই থাকতাম। আমরা লঙ্কা-ডিপুতে থাকতাম। সেখানে বাঙালিদের কোনো স্কুল ছিল না। অসমিয়া ভাষার স্কুল ছিল। তো বাবা-মা আমার লেখাপড়া নিয়ে ভাবতে লাগলেন। আমার খালা-খালু কুমিল্লা শহরে থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে আমার পড়াশোনার ব্যাপারে আলাপ করেন। পরে আমি কুমিল্লায় খালুর বাসায় থেকে শহরের লুৎফুন্নেসা স্কুলে লেখাপড়া শুরু করি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমার চাচা আমাকে ফেনীতে এনে ভর্তি করান। তখন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বৃত্তি দেওয়া হতো। আমি নোয়াখালী স্কুল থেকে বৃত্তি দিয়ে বৃত্তি পেলাম। ওই সময় ফেনীতে জাপানিরা বোম্বিং করেছিল।
বাশার খান : আপনি মেট্রিক পাস করেন কবে?
শরিফা খাতুন : নোয়াখালী সদরের উমা গার্লস স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে আমি মেট্রিক পাস করি।
বাশার খান : আপনার একটি লেখায় পড়েছি, স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় আপনি বাংলা ভাষার আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতেন।
শরিফা খাতুন : আমার স্কুল এলাকায় অনেক হিন্দু ছিল। ওই লোকেরা ব্যাপক সচেতন ছিল। ওখানে ব্রিটিশ আন্দোলন হয়েছে। স্কুলের ছাত্রী থাকাকালীন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দু-একটি মিছিলেও আমি গিয়েছি। তখনো কিন্তু ভাষা আন্দোলন শুরু হয়নি।
বাশার খান : হ্যাঁ, ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ প্রকাশ্যে আসে।
শরিফা খাতুন : দেশভাগের পর তো জিন্নাহ ’৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তখন আন্দোলনটা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নোয়াখালীতে তখন মিছিল হয়েছে বাংলা ভাষার পক্ষে। আমরা স্কুলের ছাত্রীরা সে মিছিলে অংশ নিয়েছি। মূল আন্দোলন ঢাকায় হলেও ওই সময় বাংলা ভাষার ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা চেতনা তৈরি হয়েছিল।
বাশার খান : ঢাকায় আন্দোলনের খবর পেতেন কীভাবে?
শরিফা খাতুন : আমি তো খালুর বাসায় থাকতাম। খালু আইনজীবী ছিলেন। বাসায় বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আসত। সেগুলো পড়েই আমি ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে নানা রকম তথ্য পেতাম।
বাশার খান : এবার মূল ঘটনায় আসি। ভাষা আন্দোলনে আপনি সরাসরি জড়িত হন কবে এবং কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে?
শরিফা খাতুন : ১৯৫১ সালে আমি ইডেন গার্লস কলেজে ইন্টারে ভর্তি হই। তখন এটা ইডেন গার্লস কলেজ ছিল। আমি তো মফস্বল থেকে এসেছি, তাই হোস্টেলে সিট পেয়ে গেলাম। হোস্টেলের রিডিং রুমে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আসত। আমরা বান্ধবীরা সেগুলো পড়তাম।
বাশার খান : তখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলন বেশ চাঙ্গা। তো আপনি সরাসরি জড়িয়ে গেলেন কীভাবে?
শরিফা খাতুন : ১৯৫২ সালের জানুয়ারি শেষের দিকে খাজা নাজিমুদ্দিন তো ঢাকা এলেন। তিনি পল্টনের জনসভায় ঘোষণা দিলেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।
বাশার খান : হ্যাঁ, পাকিস্তানের সে সময়ের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ৫২-এর ২৭ জানুয়ারি জিন্নাহর ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করেন। অনেক ভাষা সংগ্রামী আমাকে বলেছে, এই ঘোষণাই মূলত একুশের পরিবেশ তৈরি করে।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ। খাজা নাজিমুদ্দিন কিন্তু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের চাপে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে গণপরিষদে কথা বলবেন কথা দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখলেন না। ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। সে প্রতিবাদের প্রভাব আমাদের হোস্টেলে এসে পড়ল। আমরা বিস্তারিত জানলাম। তখন ছাত্ররা ধর্মঘট ডাকল।
বাশার খান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৩০ জানুয়ারি ধর্মঘট আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভা হয়। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেওয়া হয়। গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ।
শরিফা খাতুন : ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সভা ডাকে। আমরা ইডেন গার্লস কলেজে ছাত্রীরা সে সভায় অংশগ্রহণ করেছি।
বাশার খান : তখন থেকেই সরাসরি নেমে গেলেন ভাষা আন্দোলনে?
শরিফা খাতুন : তার আগেও তো সচেতন ছিলাম। সব খবর রাখতাম আমরা হোস্টেলের মেয়েরা। ওই সময় চিঠির যে খাম ছিল, তাতে উর্দু ও ইংরেজি লেখা ছিল। কোনো বাংলা লেখা ছিল না। খুব খারাপ লাগত। তো ৪ ফেব্রুয়ারি যে মিটিংটা হয়, সেখানে আমি গিয়েছি।
বাশার খান : আপনার সঙ্গে আর কে কে ছিল?
শরিফা খাতুন : ইডেন কলেজের জিএস মনোয়ারা বেগম। আরো ছিলেন মতি আপা, জেবুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা, শাহাদত আরা, আমিরুন্নেসা, রওশন জাহান হেনা, ফিরোজী বেগম, সুফিয়া খাতুন, রাহাত আরা, শহর বানু। আরো অনেকের নাম এখন আর মনে নেই।
বাশার খান : মিটিংয়ে যাওয়া ছাড়া আপনারা আন্দোলনের পক্ষে অন্য আর কোনো কাজ করতেন কি?
শরিফা খাতুন : আমরা পোস্টার লিখে দেয়ালে সাঁটাতাম। সবার মুখে একটাই আলোচনা- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। রাষ্ট্রভাষা সংবলিত ব্যাজ বিলির কাজ করেছি। আমাদের আরেকটি দায়িত্ব দেওয়া হলো যে, মেয়েদের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে বোঝাতে হবে। ঢাকা শহরে যে কয়টা স্কুল ছিল, সেগুলোতে প্রচারণা চালানোর দায়িত্ব পড়ল আমাদের ওপর। আমরা কয়েকজন ছাত্রী মুসলিম গার্লস স্কুলে গেলাম। আমার সঙ্গে গেল- আমার বান্ধবী রওশন জাহান হেনা, শহর বানুসহ পাঁচ-ছয়জন। মুসলিম স্কুলে দারোয়ান আমাদেরকে ঢুকতে দিল না। আমরা বললাম, কয়েকজন ছাত্রীকে ডেকে দেন। দারোয়ান ডেকে দিল। আমরা ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচির কথা জানাই। ২১ তারিখের কর্মসূচির কথা তারা আগে থেকেই কিছুটা জানত।
বাশার খান : তার পরের ঘটনা সম্পর্কে বলুন।
শরিফা খাতুন : তারপর তো ২০ ফেব্রুয়ারি চলে এলো। বিকেলে হঠাৎ করে শুনি মাইকিং হচ্ছে যে, পরদিন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
বাশার খান : মাইকিং সরকারই করছিল?
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ, সরকারের লোকেরাই সবাইকে সতর্ক করে মাইকিং করে। আমরা সবাই চিন্তায় পড়ে গেলাম- কী হবে। রাতে ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলের ছাত্রনেতারা ইডেন কলেজের গেটে এসে আমাদের জিএস আপাকে জানালেন, ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। আমাদের সবাইকে যেতে হবে। ২১ তারিখ সকালে ৯টার দিকে আমরা নাশতা করে আমতলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। সকালে ইডেনের গেট বন্ধ ছিল। আমরা কেউ দেয়াল কেউ গাছ বেয়ে দেয়াল পার হলাম। আমি আবার গ্রামে বড় হয়েছি। গাছে মোটামুটি উঠতে পারতাম। তো আমরা আমতলা দিকে চললাম।
বাশার খান : কতজন ছাত্রী দেয়াল টপকে গেলেন?
শরিফা খাতুন : হোস্টেল থেকে ৩০ জনের মতো ছাত্রী গিয়েছি। সঙ্গে ব্যানার ছিল। ১৪৪ ধারা তো- আমরা কয়েকজন কয়েকজন করে গিয়েছি। সবাই একসঙ্গে যাইনি। রাস্তায় পুলিশ দেখতে পেলাম- হাফপ্যান্ট পরা, হাতে লাঠি। আমতলায় গিয়ে দেখি, অনেক লোকজন। মুসলিম স্কুল থেকেও মেয়েরা এসেছে। কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীরাও ছিল। শ খানেক মেয়ে ছিল মনে হয়। আমরা আমতলার একপাশে বসলাম। একটা ডায়েস ছিল। বোধহয় ১২টার দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ডায়াসে বসলেন। মিটিং শুরু হলো। সভায় গাজীউল হক সভাপতি ছিলেন। আগের রাতেই তাঁদের সিদ্ধান্ত ছিল- ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে।
বাশার খান : ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে কিছুটা মতপার্থক্য হয়।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ, তবে বেশির ভাগ নেতাই এর পক্ষে ছিলেন। তারপর সাড়ে ১২টা বা ১টার দিকে বোধহয় সভা শেষ হলো। তখন পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে বর্তমান জগন্নাথ হলে অধিবেশন হচ্ছিল। সেখানে গিয়ে রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলে ধরার জন্য সবাই তৈরি হয়। শান্তিপূর্ণভাবে যাওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল সবার। কারো মাথায় ইট-পাটকেল নিক্ষেপের কোনো চিন্তা ছিল না। ১০ জন ১০ জন বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। প্রতিটি দলে একজন ছাত্রী থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ছাত্ররা আগে যাবে। প্রক্টর অফিসের গেটের সামনে থেকে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। কয়েকটি দল বের হলো। এরপর আর মিছিল হচ্ছে না। পুলিশ বাধা দিল। ইটপাটকেলের প্রচণ্ড শব্দ শুনলাম। পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করল। প্রথমে যারা বের হয়েছে, তাদের অনেকেই আহত হলো।
বাশার খান : গাজীউল হকও আহত হন।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ। উনি তো অজ্ঞানই হয়ে যান। আমরা তো সবাই আতঙ্কিত। এর আগে তো লাঠিপেটা-টিয়ার শেলের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। পুলিশ অনেককে ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। টিয়ার শেলে আমাদের চোখ জ্বলছে। কে যেন পানি এনে দিল। চোখে পানি দিলাম।
বোধহয় ৩টার দিকে গুলির শব্দ শুনলাম। কে বা কারা নিহত হয়েছে তা জানতে পারিনি। কলাভবন ও মেডিকেল কলেজের মাঝখানে একটা দেয়াল ছিল। দেয়ালটা ভাঙা হলো। আমার বান্ধবী রওশন জাহান হেনার ভাই জাহাঙ্গীর মেডিকেলে পড়তেন। তিনি আমাদের নিরাপদে হোস্টেলে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিলেন। ডা. জাহাঙ্গীর পরে ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ হন। আমরা তাঁর সহযোগিতায় হোস্টেলে নিরাপদেই এলাম। বিকেল ৫টা দিকে শুনি অনেকে নিহত হয়েছে। আহতরা হাসপাতালে। কয়েকজন ছাত্রীও আহত হয়। কে কে নিহত হয়েছে তা জানতে পারিনি। খবর আসছে- লাশ গুম করা হয়েছে। হোস্টেল থেকে আমরা কয়েকজন ঢাকা মেডিকেলে আহতদের দেখতে গেলাম। ছাত্ররা আহত। চারদিকে হাহাকার। পরে বরকত, জাব্বার, শফিউলরা শহীদ হয়েছে- সে খবর পেলাম। পরদিনও মিছিল –মিটিং হয়েছে।
বাশার খান : শহীদ মিনার তৈরির বিষয়ে কিছু বলুন।
শরিফা খাতুন : ২৩ তারিখ রাতে লুকিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হলো। ভোরে উদ্বোধন করা হয়। আমরা উদ্বোধনের পর সকালের দিকেই সেখানে গিয়েছি।
বাশার খান : বিভিন্ন ভাষা সংগ্রামী বলেছেন, সেই দিন অনেক ছাত্রী নিজের গহনা শহীদ মিনারের পাদদেশে অর্পণ করে।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ, আমরা গিয়েও সেখানে গহনা পড়ে থাকতে দেখেছি। এগুলো আহতদের চিকিৎসা ও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দেওয়া হয়। অনেক ছাত্রী টাকাও দিয়েছিল।
বাশার খান : তাহলে আমরা বলতে পারি, ভাষা আন্দোলনে নারী শুধু সক্রিয়ভাবে অংশই নেয়নি বরং নিজের গায়ের গহনা ও টাকা দিয়ে সাহায্যও করেছে।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ, ইডেন কলেজে আমরা একদিন রান্না করে জেলখানায় পাঠিয়েছি।
বাশার খান : এর পরের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাই।
শরিফা খাতুন : এরপর তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হলো। আমাদের কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। হোস্টেল থেকে চলে বলা হলো। আমি ট্রেনে করে আখাউড়া আমার বান্ধবী শহর বানুর বাবার বাসায় গিয়ে রইলাম। আমার বাবা সিলেট থেকে এসে আমাকে নিয়ে যান।
বাশার খান : ভাষা আন্দোলন চলে ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত। ২১ ফেব্রুয়ারি পর ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে কতটুকু মনে পড়ছে?
শরিফা খাতুন : আমি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হই। তখনো আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে।
বাশার খান : অনেক ছাত্রী গ্রেপ্তার হয়।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ। অনেককেই সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙার দায়ে পুলিশ ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়।
বাশার খান : অনেকে আমাকে বলেছেন, সেদিন গ্রেপ্তার হওয়া ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২০-২১ জন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম নারী অধ্যাপক লায়লা নূরও ছিলেন।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ, লায়লা আপা আমার পরিচিত। উনি আমার সিনিয়র ছিলেন। লায়লা আপার সঙ্গে আমিও মিছিল-মিটিংয়ে গিয়েছি।
বাশার খান : বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রীরা গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে সরকারের কিছুটা টনক নড়ে। পরের বছর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
শরিফা খাতুন : হ্যাঁ। পাকিস্তান ’৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয়।