২০১৬
উদ্যোগ নিলে গতিশীল হবে অর্থনীতি
জেনেভাভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৪-১৫-এর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতা সূচকে একধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯, যদিও স্কোর আগের মতোই ৩ দশমিক ৭। অন্যদিকে ১৫ ধাপ এগিয়ে প্রতিবেশী নেপাল ১০২, ছয় ধাপ এগিয়ে ১০৩ শ্রীলংকা আর পাঁচ ধাপ এগিয়ে মিয়ানমার ১৩৪তম।
অগ্রগতির খতিয়ানের তুলে ধরার পাশাপাশি ‘অবকাঠামো দুর্বলতা’ ব্যবসা করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। সঙ্গে দুর্নীতি, দক্ষ জনবলের সংকট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নীতির ভারসাম্যহীনতাসহ বেশ কিছু বিষয়ও রয়েছে। উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে পৌঁছাতে হলে নতুন বছরে এসব বিষয়ে বাংলাদেশকে দৃষ্টি দিতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল- তাই এখনই সময়, সমস্যা কাটিয়ে সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাওয়ার। সাধারণভাবে দেশের অর্থনীতির হালচাল জানতে কয়েকটি অর্থনৈতিক সূচক তুলে ধরা জরুরি।
নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ : বর্তমানে মাথাপিছু আয় এক হাজার ১০০ ডলারের কিছু বেশি। এরইমধ্যে যা বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার কথা বলছে সরকার। সেক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় হতে হবে চার হাজার ১২৫ ডলার। সেই হিসাবে আগামী ৬ বছরে আয় বাড়াতে হবে তিন হাজার ডলার! এত অল্প সময়ে ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাথাপিছু আয় এতটা বাড়ানো রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার।
উন্নয়নের পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য বাকি দুই উপাদান মানব সম্পদ উন্নয়ন ও ঝুঁকিমুক্ত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। মানব সম্পদ উন্নয়ন আর মাথা পিছু আয় আবার পরিপূরক। অর্থাৎ মানব সম্পদের উন্নয়ন হলে বাড়বে মাথাপিছু আয়। অথচ দক্ষ মানব শক্তির প্রথম শর্ত শিক্ষার মান উন্নয়ন। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজিতে দুর্বলতা বাড়ছে শিক্ষার্থীদের। দুর্বল ভিত্তি কাটিয়ে উঠতে না পারলে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন সম্ভব নয়। শিক্ষাবিদসহ গবেষকরা বারবার বলা সত্ত্বেও এসব বিষয়ে নজর দেওয়া হচ্ছে না। বরং জিপিএসহ পাশের হার বৃদ্ধিতে মনোযোগ বেশি সরকারের। পাঠ্যপুস্তক উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে নতুন বছরে শিক্ষার সব স্তরে সংস্কার নেওয়া হবে আগামীর জন্য স্বপ্নবুনন। গতানুগতিকতার বাইরে সে পথে মন্ত্রণালয় কতটা হাঁটবে তা বলা মুশকিল।
বিনিয়োগ : বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি হলো সরকারি বিনিয়োগ। মূলত সরকারি এই বিনিয়োগ হয় সড়ক, রেল, সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎসহ জ্বালানিকেন্দ্র স্থাপন ও সংস্কারসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করে। এর মাধ্যমে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়, যা আমদানি-রপ্তানিসহ স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড গতিশীল করতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে সরকারি বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয় বেসরকারি বিনিয়োগ। আবার স্থানীয় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ দেখে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয় বিদেশিরা। ফলে বাংলাদেশের জন্য সরকারি বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই সরকারি বিনিয়োগ বা বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নিয়ে নেই কোনো সন্তোষজনক তথ্য। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত এডিপির বাস্তবায়ন মাত্র ১৭ ভাগ, যা গেল তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অনেক মন্ত্রণালয় আছে যা তিন মাসে একটি টাকাও খরচ করতে পারেনি। তারপরও অতীতের মতো বছর শেষে বাস্তবায়ন দাঁড়াবে ৯০ থেকে ৯৫ ভাগে! এজন্য তড়িঘড়ি করে শেষ তিন মাসে অর্থছাড় যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আর এভাবে বাস্তবায়ন হার বেশি দেখাতে গিয়ে সরকারি ব্যয়ের গুণগত মান কমছে, বাড়ছে অর্থের অপচয়। শত শত কোটি টাকা খরচ করেও প্রকল্প থেকে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফলাফল। যদিও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ানো হচ্ছে এডিপির আকার।
প্রকল্প বাস্তবানের দীর্ঘসূত্রতার কারণে বাড়ছে প্রকল্প ব্যয়। সংশোধিত অনেক প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হচ্ছে দ্বিগুণ তিনগুণ। ব্যক্তি হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব নেই, কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়ন সেই দক্ষতা-সক্ষমতার প্রমাণ মেলে না। যোগ্য লোককে সঠিক জায়গায় দায়িত্ব না দেওয়াসহ রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়ায় জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়ন গতিশীল করতে বিদায়ী ২০১৫ সালে পরিস্থিতির উন্নয়নে এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ২০১৬ সালের গতি প্রকৃতিতে খুব কিছু পরির্বতনের সুযোগ নেই।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনা। স্বাভাবিক কারণেই কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়েনি বেসরকারি বিনিয়োগ। ব্যাংকে এক লাখ কোটি অলস টাকার স্তূপ প্রমাণ করে বিনিয়োগ মন্দা চলছে দেশে। ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কারণ বিনিয়োগের জন্য দু’চার মাস যথেষ্ট নয়, দরকার লম্বা সময় স্থিতিশীল পরিবেশ। ছোট খাট সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে পৌর নির্বাচন। ফলে নতুন বছরে আশা করা যায় রাজনৈতিক উত্তেজনা টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি আসবে না। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামী জুন-জুলাই এ দেশের বিনিয়োগ খড়া কাটতে শুরু করবে। কারণ দেশি বিদেশি এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বাংলাদেশ এখনো বিনিয়োগের জন্য লোভনীয়। ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ হার ছাড়াও আরো দু-একটি বিষয় বিনিয়োগ বান্ধব নয়। বিশেষ করে বিনিয়োগ অনুমতি, গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ, পরিবেশ ছাড়পত্রসহ বিনিয়োগের জন্য ১০-১২টি মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে ছুটাছুটিতে আগ্রহ কমে যায় বিদেশিদের। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশ বিনিয়োগ টানছে। কিন্তু বাংলাদেশে সেই রাশভারি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে নেই উদ্যোগ। তাই বিনিয়োগের চিত্রও পাল্টাচ্ছে না। অথচ প্রতি বছর, কাজের বাজারে আসে ২২ লাখ নতুন মুখ। সুযোগ পায় মাত্র সাত লাখ তরুণ-তরুণী। বেকারত্বের দল ভারি হচ্ছে কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বিনিয়োগ না হওয়ায়।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন : বিনিয়োগের অন্যতম পূর্বশত রেল-সড়ক-বন্দরসহ ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন। বিদ্যুৎসহ জ্বালানি পরিস্থিতির বেশ খানিকটা উন্নতি হলেও তা এখনো টেকসই হয়নি। অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ এখনো শেষ হয়নি। খরচ ও সময় দ্বিগুণ বাড়িয়েও লাভ হয়নি। কাজ যখন শেষ হবে তখন হয়তো চার লেনের গুরুত্ব হারিয়ে ছয় লেনের দাবি জোড়ালো হবে। এ পথে আলাদা রেল লাইন নির্মাণ এখনো নীতিবাক্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সামান্য কিছু উন্নতি হলেও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা এখন অনেক পিছিয়ে। মংলা বন্দর দিয়ে নেপাল ও ভূটানের সঙ্গে আঞ্চলিক বাণিজ্যিক যোগাযোগ কাজে লাগাতে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নেই গতি। রেল ও জলপথের চেয়ে অবকাঠামো উন্নয়নে ভারতীয় ১০০ কোটি ডলারের ঋণ প্রকল্প চলছে ঢিমেতালে। সড়ক পথের চেয়ে সময় ও আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী এ দুটি মাধ্যমের চেয়ে সড়ক পথে বেশি মনোযোগ সরকারের। পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণকাজের ভিত্তি প্রস্তরে নতুন স্বপ্ন রচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এর মাধ্যমে ৬ শতাংশের বৃত্তে আটকে থাকা প্রবৃদ্ধির জট খুলতে পারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সময় মতো পদ্মা সেতুর কাজ বাস্তবায়ন জরুরি। নজর রাখতে হবে যেন দেশের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেন প্রকল্পের মতো ঝুলে না যায়।
মূল্যস্ফীতি : গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৬ ভাগের মধ্যে, যা বাজেট ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম। বিদায়ী বছরে দুই দফা গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির পরও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিনটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে। এক. আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের দাম গেল বছরগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। দুই, বিশ্ববাজারের খাদ্য পণ্যের উৎপাদন ও দাম সহনীয় এবং তিন, দেশে ধান, সবজি, মাছসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্যের যথেষ্ট উৎপাদন। কিন্তু প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ৪০ থেকে ২৩ ডলারে নামলেও সরকার দেশের বাজারে দাম সমন্বয় করেনি। ফলে এর সুফল পায়নি দেশের মানুষ। বরং একচেটিয়া মুনাফা করেছে বাংলাদেশে পেট্রলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি ও তেলভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। মুনাফা এতটাই করেছে যে রাতারাতি লোকসানি প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছে। তেলের মূল্য আরো কমার ইঙ্গিত দিচ্ছে আইএমএফসহ নানা প্রতিষ্ঠান। খানিকটা দাম সমন্বয় করলেও দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও পরিবহন খরচ কমত। এই প্রণোদনায় আরো গতিশীল হতো সামগ্রিক অর্থনীতি, সুফল পেত গোটা দেশের মানুষ। কিন্তু সে পথে হাঁটতে চায়নি সরকার। নতুন বছরে হাঁটবে তারও লক্ষণ নেই। উল্টো বলা হচ্ছে আবারও বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম। যা নিশ্চিতভাবে উসকে দেবে মূল্যস্ফীতিকে।
রেমিট্যান্স আয় : পৌনে এক কোটি প্রবাসীর বিপরীতে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। আগের তুলনায় বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বেড়েছে। গেল কবছর ধরেই রেমিট্যান্স আয় বেড়ে চলছে। কিন্তু এই উন্নতিতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। কারণ ৬০ লাখ প্রবাসীর বিপরীতে ফিলিপাইন রেমিট্যান্স পায় দুই হাজার ৮০০ কোটি ডলার। আর ৬১ লাখ প্রবাসী পাকিস্তানি বছরে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে এক হাজার ৭০০ কোটি ডলার। তুলনামূলক আলোচনা প্রমাণ করে শ্রম দক্ষতায় পিছিয়ে বাংলাদেশ। মূলত অশিক্ষিত ও আধা শিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিকের ওপর ভর করেই এগিয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কারিগরি দক্ষতার বৃদ্ধিতে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি কারিগরি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও মান উন্নয়নে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে আগামীতে বাংলাদেশ আরো পিছিয়ে পড়বে। এরইমধ্যে রেমিট্যান্স আহরণকারী শীর্ষ দেশের তালিকায় অষ্টম থেকে দশম স্থানে নেমেছে বাংলাদেশ।
নতুন নতুন শ্রমবাজার ধরতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে হবে সরকারকে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে লোক প্রেরণে চুক্তি হলেও এখন পর্যন্ত খুব বেশি পাঠানো সম্ভব হয়নি। প্রবাসী সাড়ে চার লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে এ বছরই গেছে প্রায় লাখ খানেক নারী শ্রমিক সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে। যাদের বড় অংশই গৃহকর্মীর কাজ করবে। তাই সংখ্যার হিসেবে বড় হলেও তাতে খুব বেশি খুশি হওয়ার সুযোগ নেই। সেই সাথে তেলের দাম কমায় হুমকির মুখে থাকা সৌদি অর্থনীতিও কোনো সুখবর দিচ্ছে না। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতায় শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছে ১০ লাখ মানুষ। অর্থনৈতিকভাবে নাজুক ইউরোপে শ্রমবাজার আরো সংকুচিত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দক্ষতার দিক দিয়ে যারা বাংলাদেশিদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সময় নষ্ট করার দিন ফুরিয়েছে অনেক আগেই।
বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ : বাংলাদেশ ব্যাংকে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভ এখন ২৭ বিলিয়ন ডলার বা দুই হাজার ৭০০ কোটি ডলারের বেশি। ২০১৫ সালেই বেড়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার, চলছে নিজের রের্কড ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস। ৭/৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো মজুদ- আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক অবস্থান তুলে ধরেছে। রির্জাভের একটা অংশ বিনিয়োগ করে দেশীয় অর্থনীতিতে রির্জাভের কার্যকর ব্যবহারের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বিদেশি ঋণ এনে দেশের অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়ছে, সেখানে অন্তত তা রাশ টেনে ধরতে ‘রির্জাভ’ ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিদেশে গচ্ছিত রির্জাভ থেকে যৎসামান্য সুদ পাওয়া যায়, সুতরাং রির্জাভ থেকে দেশের অর্থনীতি আরো কীভাবে উপকৃত হতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি।
রপ্তানি : যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা না পেলেও দেশটিতে রপ্তানি বেড়েছে বেশ ভালো ভাবেই। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের অবস্থান মোটামুটি ভালো। নভেম্বর পর্যন্ত ১১ ভাগ প্রবৃদ্ধিতে বছর শেষে সাড়ে তিন হাজার ৩০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে। কিন্তু পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ ও নতুন বাজার ধরতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকায় বাজার ধরতে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা কাজে লাগাতে ২০১৬ সালে উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে।
পূঁজিবাজার : দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বছর জুড়ে ভালো থাকলেও নেতিয়ে পড়া শেয়ারবাজারের ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। নানামুখী উদ্যোগের পরও চাঙ্গা হয়নি পুঁজিবাজার। বছর শেষে ব্যাংকের সহযোগি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আলাদা করে হিসেবের সুযোগ ও সমন্বয়ের সময় বাড়ালেও তাতে পালে হাওয়া লাগেনি। এখনো ভালো ভিত্তির অনেক শেয়ারের দাম ভিত্তিমূল্যের নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ হয়তো নতুন বছরে শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি খানিকটা প্রণোদনা জোগাতে পারে।
কালো টাকা : খোদ অর্থমন্ত্রীর ভাষায় কালো টাকার পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৪০ থেকে ৮০ ভাগ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭ থেকে আট লাখ কোটি টাকা। অঙ্কের হিসেবে পার্থক্য যেমনই হোক না কেন, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ নানা কায়দায় কালো বা অপ্রদর্শিত আয় বেড়েই চলছে। এ কারণে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার স্তূপ বড় হচ্ছে, বাড়ছে দেশ থেকে পুঁজিপাচারের ঘটনা। গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি-জিএফআই বলছে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতির জন্য এ তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার। মূলধন যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচারের অভিযোগ আছে। পুঁজিপাচারের মাধ্যমে কেবল দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছে তাই নয়, লাখ লাখ প্রবাসীর পাঠানো ডলার পাচার করছেন পুঁজিপতিরা। পুঁজির নিরাপত্তা না পেলে পাচার ঠেকানো সম্ভব নয়। ফলে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নতসহ অর্থ পাচার কমিয়ে আনতে নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে নতুন করে।
২০১৬ সালের সম্ভাবনা কাজে লাগবে তখনই, যখন সরকার সত্যিকারের উদ্যোগ নেবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন