ক্রীড়াঙ্গন ২০১৫
কী পেলাম খেলার মাঠ থেকে?
সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রত্যাশা-হতাশা এই সব যুগলশব্দ একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। কিন্তু এদের সংজ্ঞা ভিন্ন। মাপকাঠি ভিন্ন। তবু একটা বছরের শেষ প্রান্তে এসে বিভিন্নভাবে সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রত্যাশা-হতাশার সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা! সেটা আমাদের রাজনীতি-অর্থনীতি,সামাজিক-পারিবারিক সব ক্ষেত্রেই। এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও। ক্রীড়াক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। সেখানেও সেই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব। ব্যাংক স্টেটমেন্টের মতো ক্রীড়াঙ্গনেরও একটা স্টেটমেন্ট চাই সবার!
স্কোরবোর্ডের মতো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের চেহারা। শেষ হচ্ছে ২০১৫। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখা যাবে অন্য একটা সংখ্যা ২০১৬। আর ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য ব্যর্থতার বড় মাপকাটি সংখ্যা। আর এসব সংখ্যাকে মোড়ানো হয় ‘পরিসংখ্যান’নামক একটা শব্দে। পরিসংখ্যানের মোড়কের মধ্যে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে যা আছে; সেটা নিম্ম মধ্যবিত্তের অ্যাকাউন্টের চেয়েও খারাপ। এই অ্যাকাউন্টে ক্রীড়াঙ্গনে হতদরিদ্র একটা দেশের চেহারা ফুটে ওঠে!
একটু কী ভুল বলা হচ্ছে! যে দেশটা ক্রিকেট বিশ্ব্কাপে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ ইংল্যান্ডের ক্রিকেটীয় ঐশর্য্য লুটে নিল স্যার ডনের শহরে। তারা কীভাবে দরিদ্র থাকল! তারপর নিজের মাটিতে পাকিস্তান-ভারত-সাউথ আফ্রিকার ক্রিকেটীয় সম্পদের অনেকখানি রেখে দিল। এত কিছু পাওয়ার পর নিশ্চয়ই বাংলাদেশ ক্রিকেট খুব দরিদ্র তা বলা যাচ্ছে না। এটা বললে অনেকে ভ্রু কুঁচকাবেন, বক্তার মস্তিকের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। এক বছরে যারা পাকিস্তান-ভারত-সাউথ আফ্রিকা-জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জিতলো, কাউকে কাউকে ‘বাংলা ওয়াশ করল’, তারপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটের দরিদ্র চেহারার কথা বলেন কিভাবে! না,বলা যায় না। তবে ক্রিকেট নামক খেলাটা তো শুধু সাদা বল আর রঙীন পোশাকে হয় না। সাদা পোশাকে দিনের আলোতেও হয়। এবং সেই জায়গায়টা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল। টেস্ট ক্রিকেটে বলার মতো সাফল্য বলতে পাকিস্তানের বিপক্ষে একটা ড্র। ভারত, সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষেও একটা করে ড্র আছে। কিন্তু সেখানে যে বৃষ্টির ছোঁয়া আছে। তবে ক্রিকেট খেলাটা যদি শুধু ওয়ানডে হতো, তাহলে বলা যেত সোনায় মোড়ানো, না হলেও রুপায় মোড়ানো একটা বছর পার করলো বাংলাদেশ। যেখানে সাফল্য জ্বলজ্বল করছে। ১৮ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের হার মোটে ৫ টায়। এরচেয়ে ভালো পরিসংখ্যান আছে শুধু একমাত্র বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট এখনো রংচটা। তার শুভ্র চেহারাটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আক্ষেপ তাই হতেই পারে। কারণ; ক্রিকেটের ‘অভিজাত’ সংস্করণ তো টেস্ট। আভিজাত্যের ছোঁয়া সেখানে লাগেনি, তাই বলে দরিদ্র বলা যাবে না, আবার নিম্মবিত্তের চেয়ে বেশি মর্যাদাও দেওয়া যাবে না। ২০১৫ টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিম্মবিত্তই থেকে গেল।
ক্রিকেটের সবচেয়ে ক্ষুদ্র সংস্করণ ‘টি-টোয়েন্টি’তে বাংলাদেশ ঠিক কোথায় তা বলা কঠিন। নতুন বছরে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে ক্রিকেটের এই ছোট সংস্করণ। দেশের মাটিতে এশিয়া কাপ। তারপর ভারতের মাটিতে ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি। প্রত্যাশা প্রায় দিগন্ত ছোঁয়া। কিন্তু ২০১৫ সালের এই গোধূলি বেলায় দাঁড়িয়ে বলা যাচ্ছে না; ২০১৬ সালে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টির আকাশ রংধনুতে রঙিন হবে, যতই আঁতশ বাজির রঙে রাঙিয়ে শেষ হোক বিপিএলের তৃতীয় আসর। তবে বছরের শেষ দিকে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সেরা অর্জন, নারী দলের ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন।
ক্রীড়াক্ষেত্রে দরিদ্র এক দেশের বড় সাফল্যও এসেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক ঝাঁক কিশোরীর হাত ধরে। যাঁরা অনেক বাধার পাহাড় পেরিয়ে হিমালয় জয় করে এসেছেন। বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৪ দল নেপাল থেকে জিতে এসেছে এএফসি কাপ। এ জয় ময়মনসিংহের কলাসিঁদুর গ্রামের এক ঝাঁক অদম্য কিশোরীর শুধু ফুটবলে জয় নয়। দারিদ্র্য,কুসংস্কার, অন্ধকার অনেক কিছুকেই জয় করেছেন তারা। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে নারীরা জেগে উঠছেন। সেই বার্তাটা তারা দিতে পেরেছেন।
কিন্তু উল্টো চিত্র যে বাংলাদেশ ফুটবলে। সাফে আবারও ভরাডুবি। টানা তৃতীয়বার সেমিফাইনালের আগে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ থেকে বিদায় নিল বাংলাদেশ। ফুটবল নিয়ে কর্তাদের মুখে স্বপ্ন দেখানোর অনেক বুলি! ২০২২ এ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নের কথা বাজে বাংলাদেশে ফুটবল ভবনের আশপাশের বাতাসে। কিন্তু সেই স্বপ্ন উড়ে যায় চৈত্রের শিমুল তুলার মতো; বাংলাদেশ যখন আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলতে নামে। ফুটবল নিয়ে বছরের শেষ সপ্তাহে এসে অনেক বড় এক স্বপ্নের কথা শোনালেন খোদ অর্থমন্ত্রী। ২০১৮ সালের মধ্যে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপকে এশিয়ার সেরা টুর্নামেন্টে পরিণত করা হবে! অর্থমন্ত্রীর হাত ধরে প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ে। কিন্তু ক্রীড়া বাজেট কতটা বাড়ে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তারপরও অর্থমন্ত্রী যখন কথাটা বলেছেন, তাতে আশাবাদী হওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু কাপ আয়োজনে অর্থ সংকটের কথা আর বলতে পারবেন না ফুটবল কর্তারা। টাকা জোগানোর দায়িত্ব গৌরী সেনকে নেওয়া লাগবে না।
দেশের বড় এক ব্যবসায়ী নেতাও ঘোষণা দিয়েছেন টাকা যা লাগে তিনি দেবেন। এবং সেই ঘোষণা অর্থমন্ত্রী আর ফুটবল কর্তাদের সামনেই করা হয়। এখন বাকি উদ্যোগ নেয়ার দায়িত্ব ফেডারেশন কর্তাদের। তবে ফুটবলে সাফল্যের জন্য অর্থের অভাবই সব নয়। থাকলেও সেই অভাব মেটানো যায়। কারণ, দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজেই ক্রীড়াপ্রেমী। তার উৎসাহ আর চট্টগ্রাম আবাহনীর উদ্যেগে প্রথমবারের মতো ঢাকার বাইরে একটা সফল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ হলো। শেখ কামাল গোল্ড কাপের আয়োজন এবং সাফল্য বলে দেয় সদিচ্ছা থাকলে অনেক কিছু সম্ভব। ‘ সাউথ এশিয়ার দ্বিতীয় সারির দল ’ বাংলাদেশের গা থেকে এই তকমা খুলে ফেলতে হলে, দূর করতে হবে বাংলাদেশের ফুটবল কর্তাদের চিন্তার দৈন্য। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে ইউরোপ ঘুরে টুরে শেষ পর্যন্ত দেশীয় কোচের ওপর আস্থা রাখা হলো। কিন্তু দলের জন্য তাকে পর্যাপ্ত সময়, সুযোগ –সুবিধা-স্বাধীনতা দিতে হবে। না হলে পত্রিকার পাতায় ‘ফুটবলে ভরাডুবি’শিরোনামটাই বেশি দেখা যেতে পারে। যা এদেশের ফুটবলপ্রেমীরা দেখতে চান না।
ফুটবলে ব্যর্থতা ছিল। তারপর মাঠে তো খেলাটা ছিল। কিন্তু এ দেশের আর একটা সম্ভাবনাময় খেলা হকি নিয়ে মাঠের বাইরেই বেশি খেলা হলো! মাঠে হকি থাকলো না। খেলোয়াড়দের জীবন থেকে হারিয়ে গেল একটা বছর। স্টিক হাতে মাঠে নামা হলো না তাদের! হলো শুধু ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আর এক সহ-সভাপতির চেয়ার বদল। তাও গঠনতন্ত্রকে পায়ে মাড়িয়ে! আর খেলোয়াড়রা হলেন কিছু ক্লাব কর্মকর্তার কুট রাজনীতির শিকার! যে খেলাটা মাঠে থাকল না, তার ব্যর্থতা-সাফল্যের কথা লিখতে খুব বেশি শব্দ খরচ করতে হলো না। ২০১৫ সালে হকির ‘প্রাপ্তি’বলতে এইটুকু! আর নতুন বছরে প্রত্যাশা? খুব বেশি না করাই ভালো।
‘খেলব না’ এই ভাইরাস এখন হকি ছাড়িয়ে সংক্রমিত হচ্ছে অন্যান্য খেলাতেও। তাই আগামী বছর সাউথ এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ ব্যাগ ভরে ভরে পদক নিয়ে ফিরবে ভারত থেকে, সে আশা করা যাচ্ছে না। তারপরও মানুষতো আশা নিয়েই বাঁচে। ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশাসেই খেলা। আর তাদের প্রতিটি নিঃশ্বাসেই মেশানো থাকে স্বপ্ন। নতুন বছরে তাই কিছু স্বপ্ন দেখবেই এ দেশের মানুষ। কিন্তু সেই স্বপ্নের ধারক যারা, তারা কীভাবে আগামী বছরের ব্যালান্সশিট করবেন জানি না।
লেখক : স্পোর্টস এডিটর, দীপ্ত টিভি।