বিজয়ের মাস
হরিহরের পারে চিরনিদ্রায় পাঁচ সূর্যসন্তান
যশোরের মণিরামপুর উপজেলার হরিহর নদীর পারে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন পাঁচ বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৩ নভেম্বর রাজাকার বাহিনীর হাতে নির্মম-নৃশংসভাবে খুন হওয়া সেই বীরসেনানীদের ‘দুআনা দিয়ে কেনা’ জমিতে এক গর্তে একই সঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
এখানকার মানুষ ভালোবেসে তাদের নাম দিয়েছে সূর্যসন্তান। তবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের স্মরণে আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শহীদদের স্বজন আর স্থানীয় বামদলের কর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে কোনো রকমে কবরস্থানটি পাকা করেছেন।
একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (ইপিসিপি) কর্মীরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে যশোর ও খুলনা জেলা কমিটি হানাদারদের সঙ্গে লড়ার সিদ্ধান্ত নেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তাঁরা মাগুরার শালিখা থানার পুলুম ও খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায় ঘাঁটি গড়ে তোলেন।
ওই সময় দলের যশোর জেলা সম্পাদক ছিলেন শামসুর রহমান। পার্টির অন্য কর্মীদের সমন্বয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য একটি নিয়মিত বাহিনী আর একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা হয়। যুদ্ধের শুরুতেই এই কর্মীরা থানা ও ফাঁড়ি লুট করে অস্ত্র সংগ্রহের পর হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যশোর-খুলনার বেশ কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত করেন।
বিজয়ের তখনো মাস দুয়েক বাকি। চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। যশোরের মণিরামপুর-কেশবপুর অঞ্চলের হানাদার বাহিনীকে তটস্থ করে রাখেন আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি, ফজলুর নেতৃত্বে প্রখর মেধাবী মুক্তিসেনাদের এই দলটি। এই পাঁচজনের সঙ্গে ছিলেন সিরাজুল ইসলাম নামে আরেক তরুণ। রাজাকারদের হাত থেকে কৌশলে বেঁচে যাওয়া সেই তরুণ সিরাজুল এখন ৬৩ বছরে পা দিয়েছেন। নওয়াপাড়া জুটমিলে মাননিয়ন্ত্রণ পরিদর্শক পদে কর্মরত। তিনি জানান, সে সময় আসাদ ভাইদের দলটি ঘুম নষ্ট করে দেয় এ অঞ্চলের রাজাকারদের।
তাজউদ্দীন আহমদকে গাড়ি প্রদান
ইস্টার্ন ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির স্পেশাল অফিসার তোজো অফিসের গাড়ি নিয়ে যশোর হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ভারতে চলে যান। ভারতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতে আলোচনা করেন। কলকাতায় কংগ্রেস, সিপিএম নেতাদের সঙ্গেও তিনি এ ইস্যুতে কথা বলেন। শেষপর্যায়ে তোজো নিজের গাড়িটি তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে দিয়ে আসেন তাঁর কাজের সুবিধার জন্য। এরপর দেশে ফিরে আসেন যুদ্ধে অংশ নিতে।
ধরা পড়লেন ৬ জন
’৭১-এর আগস্টের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির পুলুম ঘাঁটি ভেঙে যায়। ফলে পার্টির কর্মীরা ডুমুরিয়া এলাকায় আশ্রয় নেন। ডুমুরিয়া এলাকা থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাত্রা করেন তোজো, শান্তি, মানিক, আসাদ, ফজলু ও সিরাজুল। পথে মণিরামপুর উপজেলার রত্নেশ্বরপুর গ্রামের আবদুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র যুবকরা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর রাজাকারদের চোখ এড়াতে পারেননি তাঁরা। স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আবদুল মালেক ডাক্তারের নেতৃত্বে মেহের জল্লাদ, ইসাহাক, আবদুল মজিদসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে স্বাধীনতাকামী যুবকদের। এরপর তাদের চোখ বেঁধে চিনাটোলা বাজারের পূর্বপাশে হরিহর নদীর তীরে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁদের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। তাদের শরীর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাতে লবণ দেওয়া হয়। এভাবে অমানুষিক নির্যাতন চলে ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত।
ওই দিন রাত ৮টার দিকে চোখ বাধা অবস্থায় কমরেড আসাদুজ্জামান আসাদ, কমরেড মাশিকুর রহমান তোজো, কমরেড সিরাজুল ইসলাম শান্তি, কমরেড আহসানউদ্দিন খান মানিক ও কমরেড ফজলুর রহমান ফজলুকে ব্রিজের পাশে আনা হয়। এরপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ব্রিজ থেকে দক্ষিণ-পূর্বদিকে সৈয়দ মাহমুদপুর গ্রামসংলগ্ন হরিহর নদীর তীরবর্তী স্থানে। সেখানে রাইফেল দিয়ে গুলি ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাঁদের।
সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আসাদ ভাইসহ আমাদের ছয়জনকে এক দড়িতে বাঁধে রাজাকাররা। রাজাকাররা উল্লাস করছিল। তখন তোজো ভাই বললেন, ওই ছেলেটা মাসুম বাচ্চা (আমাকে), ওকে ছেড়ে দেন। ও আমাদের সঙ্গের কেউ না; ওর চাচাকে খুঁজতে এসেছে। তখন রাজাকাররা আমাকে তাদের কাছ থেকে আলাদা করে এবং ধরে রাখে। এরপর আসাদ ভাইদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।’
সিরাজুল জানান, ওনাদের হত্যার পর এক রাজাকার বলে ওঠে- সাক্ষী রাখার দরকার নেই। এরপর তাঁকে মাটিতে ফেলে গুলি চালায়। কিন্তু গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি হরিহরে লাফ দিয়ে সাঁতরে পালিয়ে যান।
একজন শ্যামাপদ দেবনাথ
সেদিন শ্যামাপদ দেবনাথ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি নিজ হাতে কবরস্থ করেন এই পাঁচ সূর্যসন্তানকে। একাত্তরে তিনি মুটে-শ্রমিক ছিলেন। তিনি সম্প্রতি গত হয়েছেন। বেঁচে থাকাকালে নিজ হাতে প্রতিদিন পরিষ্কার করতেন কবরের ওপরের ঝোপ-ঝাড়গুলো।
মৃত্যুর আগে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় শ্যামাপদ দেবনাথের সঙ্গে। তিনি তখন স্মৃতি রোমন্থন করেন, ‘সেদিন রাতে আসাদ, তোজো, মানিক, শান্তি, ফজলুসহ ছয়জনকে ধরে আনে রাজাকাররা। রাজাকারদের সঙ্গে একজন খান সেনা ছিল। খান বলল, মেরে কাজ নেই, ওদের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দাও। কিন্তু রাজাকাররা জানায়, এদের গুলি করে না মারলে তাদের সুখ-শান্তির দেশকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।’
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন পানি খেতে চান। রাজাকাররা পানি দিতে নিষেধ করে বলে, ‘ওদের মুতে (প্রস্রাব) খাওয়াতে হবে।’ শ্যামাপদ দেবনাথ গোপনে মাস্টারদের বাড়ি থেকে বালতি এনে তাঁদের যখন খাওয়াচ্ছিলেন, সেই সময় এক রাজাকার এসে তার পিঠে রাইফেল দিয়ে আঘাত করে বলে, ‘পানি খাওয়ালি ক্যান, মুতে দে...’
এরপর রাজাকাররা বীরসেনাদের একেকজন করে আনে আর বেয়নেট দিয়ে খোঁচাতে থাকে। ওঁরা চিৎকার করে পড়ে গেলে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। এভাবে পাঁচজনকে হত্যা করে নদীর মধ্যে ফেলে দেয়। তাঁদের একজন (সিরাজুল) ওই সময় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
দুই আনার জমি
পরদিন সকালে তাদের লাশ নদী থেকে তুলে জমির মালিক অমূল্য দেবনাথ ওরফে চানমনি কবিরাজের কাছ থেকে দুই আনা দিয়ে জমি কিনে এক গর্তে পাঁচজনকে মাটিচাপা দেন শ্যামাপদ।
স্থানীয় বাসিন্দা পঙ্কজ দেবনাথ জানান, সে রাতে বেশ কয়েকটি ফায়ারের (গুলি) শব্দ হয়। পাড়ার সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। সকালে এসে দেখেন পাঁচটা লাশ। মজিদ রাজাকার সেখানে ছিল। সে ধমক দিয়ে বলেছিল, লাশের গায়ে হাত দিলে গুলি করা হবে।
জমির মালিকের ছেলে অমল দেবনাথ জানান, ‘তাঁর বাবা অমূল্য দেবনাথ (চানমনি কবিরাজ) সে সময় মেম্বার ছিলেন। নিহতদের স্বজনরা বাবাকে জানান, কবর দিতে হবে। বাবা বলেন, আমার জমি আছে; এখানে হরিহর নদীর পাশেই কবর দেওয়া হোক। টাকা লাগবে না। কিন্তু ওনারা জানান, কবর দিতে হলে জমি কিনে নিতে হয়। বাবা বললেন, ঠিক আছে দুই আনা দিও।’ স্থানীয় একটি আশ্রমের তত্ত্বাবধায়ক তপন কুমার দে জানান, সকালে উঠে শুনলাম পাঁচটি লাশ ভাসছে নদীতে। তারপর শ্যামা কাকা (শ্যামাপদ দেবনাথ) সেসব লাশ নিজে তুলে সেগুলো কবরস্থ করেন।
রাজাকার
সে রাতে রাজাকারদের মধ্যে স্থানীয় কমান্ডার ডা. মালেক, মজিদ রাজাকার, আজিজ রাজাকার, ইসাহাক ছিল। মেহের রাজাকার ছিল কি না তা মনে করতে পারেননি শ্যামাপদ।
আসাদের ভাইয়ের বক্তব্য
কথা হয় শহীদ আসাদের সেজভাই বিশিষ্ট ক্রীড়াব্যক্তিত্ব শফিকউজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসাদ আমার ছোট ভাই। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে বলছি, এ হত্যার বিচার হওয়া উচিত। যারা হত্যা করেছে, তাদের কয়েকজন এখনো জীবিত আছে। তারা এলাকায় সদর্পে চলাফেরা করছে। সরকারের উচিত তাদের বিচারের সম্মুখীন করে শাস্তি দেওয়া।’
একনজরে পাঁচ শহীদ
শহীদ হওয়া পাঁচজনের মধ্যে মাশফিকুর রহমান তেজো ১৯৬১ সালে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ১৯৬২ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি লন্ডন থেকে অ্যাকচুয়ারি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফিরে কৃষকদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
আসাদুজ্জামান আসাদ ছিলেন যশোর এমএম কলেজের ভিপি, ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের নেতা। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের সর্বদলীয় ছাত্র সংগঠনের আহ্বায়কও ছিলেন আসাদ।
সিরাজুল ইসলাম শান্তি ছিলেন জেলা কৃষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক।
আহসানউদ্দিন খান মানিক ছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের জেলা শাখার সভাপতি। তাঁরা সবাই প্রগতিশীল আন্দোলনের রূপকার ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল) সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল।
আর ফজলুর রহমান ফজলু সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলেন। তিনি ওই সময় সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে এসে আসাদ- তোজোদের সঙ্গে একাত্ম হন। এরপর সব লড়াইতে তিনি তাদের সঙ্গেই ছিলেন।
আর সেই দলের একমাত্র বেঁচে যাওয়া কিশোরটি আজকের সিরাজুল ইসলাম (৬৩)। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের অভয়নগর এলাকার তৎকালীন সেক্রেটারি রফিকুলের ভাইপো। আসাদ, তোজোরা তাঁদের বাড়িতে আত্মগোপনে থাকাকালে সঙ্গ দিতেন ওই পাঁচজনকে। সেই সময় তিনি ক্লাস টেনে পড়তেন। রাজাকারদের হাতে তিনিও ধরা পড়েছিলেন।
লেখক : জেলা প্রতিনিধি, বাংলা ট্রিবিউন