সুন্দরবনে সাংবাদিকতা
হরিণ শিকার, রান্না ও কিছু প্রশ্ন
আসন্ন দুবলার চরের রাসমেলা মানেই বছরে একটি বারের জন্য হরিণ শিকার নিয়ে গণমাধ্যমে এক নয়, বরং বহু ধরনের নানা মাত্রায় সচেতনতা তৈরির হিড়িক লেগে যায়। সপ্তাহ-মাসব্যাপী চলে রাসমেলাকে ঘিরে হরিণ শিকারের অপতৎপরতা নিয়ে পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ নানা সংবাদ আয়োজন। কিন্তু বছরের পর বছর এই জিকির করা হরিণ-সচেতন ব্যর্থ সংবাদ আয়োজন হরিণ রান্নার সুঘ্রাণের লোভ কতটা সামলে উঠতে পেরেছে, সেটি জানতে জানতে আমি ক্লান্ত ও বিব্রত।
এরই মধ্যে চোখে পড়ে এটিএন নিউজে হরিণ শিকারের একটি এক্সক্লুসিভ নিউজে। ‘বছরে একবারই হরিণ খাই, মন ভরে খাবো, যত খুশি তত খাব’—এক্সক্লুসিভ ওই রিপোর্টে কথাটি নির্দ্বিধায় বলেন একজন মুখঢাকা হরিণশিকারি; হয় সে দস্যু অথবা বছরের একদিন হরিণ খেতে ইচ্ছুক গ্রামের সাধারণ কেউ। দস্যু হোক কিংবা শিকারি অথবা সাধারণ গ্রামবাসী, রাসমেলা উদযাপনে খাবারের তালিকায় হরিণের মাংস থাকা চাই-ই চাই। সে বিচারে বছরের অন্যান্য দিনের চেয়ে রাসমেলায় আসা জনসংখ্যার চাপের মাশুল দিতে হয় সুন্দরবনের নিরীহ হরিণদের। এটি আসলে রাসমেলার অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য।
এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য নিয়ে গণমাধ্যমেরও উদ্বেগের শেষ নেই, তবে উৎসুক সংবাদ সংগ্রাহকদের এ নিয়ে অযত্ন-অবহেলারও শেষ নেই। পুরোনো খবরগুলোই হুবহু নকল করে অবলীলায় প্রকাশ করলেও বোধহয় ন্যূনতম জবাবদিহি নেই। তেমন কিছুই চোখে পড়ল ২০১৩ ও ২০১৫ সালের দুটি পৃথক সংবাদে। ২০১৩ সালে সময়নিউজ টোয়েন্টিফোর নেট-এর রিপোর্টের শিরোনাম ছিল—‘রাসমেলাকে ঘিরে সুন্দরবনে চোরাশিকারিদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি’। সংবাদটির বিশদে পড়তে গিয়ে কিছু তথ্যও পেলাম, যেমন—নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক শিকারিরা জানান, নাইলনের ফাঁদ, জাল, স্প্রিং বসানো ফাঁদ, বিষটোপ, তীর বা গুলি, কলার মধ্যে বড়শি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা ফাঁদসহ পাতার ওপর চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে নিধন করা হয়ে থাকে বিপুলসংখ্যক হরিণ। শুধু এখানেই শেষ নয়, কোনো ফাঁদে হরিণ ধরা পড়লে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থানরত শিকারিরা ছুটে গিয়ে আটক হরিণকে লাঠিপেটা করে মেরে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে জবাই করে। এর পর চামড়া, শিংসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ পাঠিয়ে দেওয়া হয় উপযুক্ত ক্রেতার কাছে। এর পর শুরু হয় মাংস দিয়ে ভূরিভোজের যত আয়োজন। লন্ডনভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ ও জুলজিক্যাল সোসাইটির তথ্যমতে, সুন্দরবনে বছরে প্রায় ১০ হাজারের বেশি হরিণ শিকারিদের হাতে মারা পড়ে। সুন্দরবনের বন বিভাগের হিসাবমতে, বনের বাংলাদেশ অংশে বর্তমানে এক লাখ ২০ হাজার চিত্রল হরিণ রয়েছে। তবে আয়তন, খাদ্য ও সার্বিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে এর প্রকৃত সংখ্যা। মেলা চলাকালীন আনন্দে মাতোয়ারা দর্শনার্থী ও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব চোরাশিকারি সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, আলোর কোল, কটকা, কচিখালী দুবলা চান্দেরশ্বর, বগি, চরখালী, তালপট্টিসহ যেসব এলাকায় হরিণের বেশি বিচরণ, শিকারিরা সেসব এলাকায় বিভিন্ন ফাঁদ দিয়ে শিকার করে হরিণ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সুন্দরবনসংলগ্ন চোরাশিকারি চক্র এক প্রকার ফেরি করে বিক্রি করে থাকে হরিণের মাংস। বনরক্ষীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে ফাঁদসহ শিকারিদের কেউ কেউ, উদ্ধারও হচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাংস। হরিণ নিয়ে এমন চিত্র বলে দেয়, সুন্দরবনের গহিনেও ভালো নেই অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় এই প্রাণীরা। চোরাশিকারিরা দলবেঁধে বৈধ-অবৈধ উপায়ে সুন্দরবনে ঢুকে গুলি করে, ফাঁদ পেতে অথবা চেতনানাশক ট্যাবলেট দিয়ে ব্যাপক হারে হত্যা করছে সুন্দরবনের মায়াবী চিত্রল হরিণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য সংকটে বাঘ-কুমিরের আক্রমণে মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত বেপরোয়া চোরাশিকারিদের অপতৎপরতায় প্রতি মাসে মারা পড়ছে শত শত হরিণ।
জানা যায়, খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর, কালিকাপুর, চৌকুনি, তেঁতুলতলারচর, শেখেরকোনা, মাঠের কোন, ৪ নম্বর কয়রা, ৬ নম্বর কয়রা, শাকবাড়িয়া, গুড়িয়াবাড়ী, পাতাখালী, জোড়াশিং, গোলখালি, খাশিটানা, গতির ঘেরি, পাইকগাছার, চাঁদখালি, লস্কর, সোলাদানা, পশ্চিম বন বিভাগের সাতীরা রেঞ্জের, শ্যামনগর, উপজেলার গাবুরা, ডুমুরিয়া, ৯ নম্বর সোরা, পারশেমারী, চাঁদনী মুখ, জেলেখালী, বুড়িগোয়ালিনীর দাতিনাখালী, মুন্সীগঞ্জের বিজয় সরদারের ঘাট, মীরগাং, যতীন্দ্র নগর, রমজাননগর, কালিঞ্চী, টেংরাখালী, কৈখালী, জয়খালী, বাগেরহাটের শরণখোলা, সোনাতলা, তফালবাড়ী, চালরায়েন্দা, উত্তর তাফালবাড়ী, তালজোড়া, মংলাসহ সুন্দরবনসংলগ্ন হরিণটানা, মরাতোলা, তেঁতুলবাড়িয়া, আড়াইবেঁকী, নাওলী জনপদের বহু মানুষ এক প্রকার পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে হরিণ শিকার।
ঝামেলা বাধল ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বরের দৈনিক ইত্তেফাকের সংবাদ পড়ে। ওই সংবাদের শিরোনাম ‘দুবলার চরে রাসমেলা’; কিন্তু এর বিশদের বেশ কিছু অংশবিশেষ হুবহু ২০১৩ সালে প্রকাশিত সংবাদের নকল বা পুনঃপ্রকাশ।
এই পুনঃপ্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, ‘সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা, পাইকগাছা শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ, নওয়াবেঁকী, কাশিমবাড়ী, বংশীপুর, নুরনগরসহ সেখানকার প্রত্যন্ত এলাকায় কেজিপ্রতি হরিণের গোশত পাওয়া যায় মাত্র ৪০০-৫০০ টাকায়। এ ছাড়া তাদের কাছ থেকে একশ্রেণির ব্যবসায়ী গোশত কিনে তা বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার করছে দেশের বিভিন্ন জেলা সদরসহ রাজধানীতে। কখনো কখনো তাদের দুই-একজন গ্রেপ্তার হলেও অধিকাংশই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে বন বিভাগের চেয়ে পুলিশের হাতে মাংস উদ্ধারের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।’ এমন চোখ এড়ানো গাফিলতি এবং নকল চালিয়ে সংবাদ শূন্যতা পূরণের দায় আসলে কার?
ফিরে আসি এটিএন নিউজের সেই প্রচারিত এক্সক্লুসিভ নিউজে। অবাক হলাম, হরিণ হত্যার বীভৎস সব দৃশ্য অবলীলায় কীভাবে প্রচারিত হয়েছে সেটা দেখে, হরিণের কাটা মাথার মাংস ছাড়াচ্ছে কেউ, হত্যার পর নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে পড়ে থাকা মৃত হরিণ শাবকের শরীরে মাছির উপদ্রব, চামড়া ছাড়ানোর নৃশংস দৃশ্য, সে সঙ্গে ফাঁদ পাতার অভিনব কায়দা। আরেকটি বিষয় দেখে খুব অবাক হলাম, হরিণ শিকারিদের পরিচয় গোপনের স্বার্থে ছবি ঝাপসা করে দেওয়া, বিষয়টি অনেকটা এমন যে অপরাধীকে আড়ালে রেখে ভুক্তভোগীকে ফলাও করা। এ ধরনের নির্বুদ্ধিতাও কম হয় না প্রচারমাধ্যমগুলোতে। নৃশংস দৃশ্যের ছবি ঝাপসা না করে অপরাধীর ছবি ঝাপসা করা কেমন সাংবাদিকতা? ওই নিউজে আরো দেখা যায়, হরিণের জন্য ফাঁদ পাততে থাকা একটি দলকে। বিষয়টি বেশ নাটুকে এবং সংবাদের স্বচ্ছতায় প্রশ্ন তুলে। এ ধরনের অবস্থায় সংবাদ সংগ্রাহকের অবশ্যই উচিত ছিল এমন এক্সক্লুসিভ না করে বরং অপরাধী চক্রের মুখোশ উন্মোচন করা, তা না পারলে অপরাধীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সাহায্য করা। এসব এক্সক্লুসিভ নিউজেরও রয়েছে কিছু অন্দরমহলের খবর। ঢাকায় সংবাদ সংগ্রাহকদেরই কিছু অভিনব সোর্স এসব তথ্য দিয়ে থাকে, তা আমরা কমবেশি সকলে জানি, আমার কাছেও আসত এমন তথ্য। এমনকি হরিণের ফাঁদ পাতা শিকারের দৃশ্য দেখারও আমন্ত্রণ পেতাম, সঙ্গে শিকার করা হরিণ। কিন্তু রুচিগত কারণে এসবে সায় দিইনি কখনো। এখন দেখি এসব ঘটনায় অনৈতিক অংশগ্রহণ সংবাদমাধ্যমে এক্সক্লুসিভ চর্চার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
আরেকটি একই ধরনের নিউজ দেখলাম যমুনা নিউজে। বেশ নাটুকে নিউজ প্যাকেজ। সাহসী সংবাদ সংগ্রাহক ছোট্ট ডিঙি নৌকা করে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ গুলির শব্দ! অকুতোভয় সংবাদ সংগ্রাহক নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লেন ঘটনাস্থলে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ‘গভীর সুন্দরবনে গুলির শব্দ শুনেই বনে ঢুকতেই চোখে পড়ে শিকারিদের চলাফেরা।’ পরের দৃশ্যে আমরা দেখি, মৃত হরিণ কাঁধে চাপিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একজন শিকারি, এরপর শুনি ‘বিশাল এই হরিণটিকে হত্যা করা হয় গুলি করে’। এরপর যথারীতি শিকারির পরিচয় গোপন স্বার্থে ঝাপসা সাক্ষাৎকার, আরো দেখা যায় ফাঁদে পা দেওয়া নিরীহ হরিণকে বেঁধে চলছে হত্যার প্রস্তুতি, দেখানো হচ্ছে ফাঁদ পাতার কৌশল—এ যেন কর্মশালা। কিন্তু কেন? আমার সাধারণ বোকা প্রশ্ন। উত্তরটি সহজ, যেহেতু এ ধরনের সংবাদ করা হয় শিকারি সোর্সের সহযোগিতায়, তাই গোপন রাখা হয় তাদের পরিচয়। কিন্তু সংবাদের জন্য এ ধরনের কাজ কতটা নৈতিক? আকস্মিক গুলির শব্দে কেউ নৌকা থেকে লাফিয়ে শিকারিদের চলাফেরা দেখতে যাবেন না। দর্শক ঠিকই বুঝতে পারেন এমন সংবাদ আসলে পরিকল্পিত। তাহলে সংবাদের স্বচ্ছতা থাকল কোথায়? নিউজ প্যাকেজটির একপর্যায়ে আমরা শুনতে পাই, ‘বিশাল বনে চোরাশিকারিদের ধরাটাও বেশ কঠিন, আর ধরা পড়লেও শাস্তি হয় না বলে উৎসাহ হারাচ্ছেন বন বিভাগের কর্মীরা।’ ঠিক এরপরই নাম না জানা এক বনকর্মীর স্বীকারোক্তি। আমার আবার একটি বোকা প্রশ্ন জাগে মনে, গুলির শব্দে ভয় না পেয়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যে ব্যক্তি সংবাদ সংগ্রহে যান, তিনি কেন এ ধরনের অপরাধে অনুসন্ধানী সাহসী ভূমিকা রাখতে পারেন না? উত্তরও সহজ, এর পেছনে মাথাওয়ালা রাঘববোয়াল আছেন। তাই যদি হয়, তবে কেন হরিণের নির্মমতা ও বীভৎসতাকে পুঁজি করে এ ধরনের সংবাদ উপস্থাপন করা হয়?
সাংবাদিকতা সত্যকে প্রকাশ করে, কিন্তু কোনো অন্যায়কে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করে না। সাংবাদিকতার পরিমিতিবোধের পাশাপাশি নীতিনৈতিকতা বোধও থাকা জরুরি। তার পরও খুব বেশি বিলম্ব হয়নি বলে ন্যূনতম আশা রাখি, সংবাদ সংগ্রাহকদের নৈতিক সুস্থতার বিকাশ কামনা করি।
লেখক : ভিজ্যুয়াল জার্নালিস্ট, বিবিসি, এমএ।