পর্যবেক্ষণ
চাকরির বয়স প্রবেশের নয়, অবসরের বাড়ে
আমাদের সময়ে সচেতন অভিভাবকদের দেখতাম, সন্তানদের ক্লাস সিক্সে ভর্তি করানোর সময় বয়স কমিয়ে দেখাতেন। যে বয়স না দেখালেই নয়, সেই বয়স দেখিয়ে ক্লাস নাইনে রেজিস্ট্রেশন করাতেন। বর্তমানে এই ফাঁকিবাজিটা জন্মনিবন্ধনে চলে এসেছে। কারণটা ছিল, যাতে শিক্ষাজীবন শেষে চাকরিতে প্রবেশের প্রস্তুতির সময়টা বেশি পাওয়া যায়।
তারপর অনেকদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়লেটগুলোতে এ রকম একটি বাক্য দেখেছিলাম : ‘বয়স জীবন খায়, বয়স জীবন যায়’। বয়স খোয়ানো তরুণদের এটা এক চরম হতাশাক্রান্ত উক্তি। সেশনজটসহ নানা কারণে একজন শিক্ষার্থী যখন শিক্ষাজীবন অতিক্রম করে যখন দেখতে পায়, তার চাকরিতে প্রবেশের বয়স আছে মাত্র তিন থেকে চার বছর, তখন তো আর হতাশার শেষ থাকে না। আর লেখাপড়া শেষ করা মাত্রই তো চাকরির বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয় না। যেমন ২৭তম থেকে ২৮তম বিসিএসের সময়ের তফাত ছিল পাক্কা তিন বছর। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাজীবন শেষে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষায় বসতে পায়।
ডাক্তারদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে, বাকি শিক্ষার্থীদের তুলনায় তাদের এক বছর বেশি অধ্যয়ন করতে হতো। কিন্তু পরে যখন বাকিদেরও অধ্যয়নের সময় বাড়িয়ে সমান করা হয়, তখন আর বাকিদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করা হয়নি। ৩১ জানুয়ারি ২০১২ সালে তত্কালীন স্পিকার ও বর্তমানের রাষ্ট্রপতি সংসদে এটির প্রস্তাবও তুলেছিলেন।
আমরা তো কথায় কথায় উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দিতে পছন্দ করি, সেই দেশগুলোতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমাটা জেনে নেওয়া যাক। রাশিয়া ও ইংল্যান্ডে ৩৪ থেকে ৪৪ বছর, ফ্রান্সে ৩৫ বছর, যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪ থেকে ৩৬ বছর, কানাডায় ৬০ থেকে ৬৫ বছর, ইতালিতে ৩৮ বছর, ফিলিপাইন, তুরস্ক ও সুইডেনে যেকোন বয়সে, ইন্দোনেশিয়ায় ৩৫-৩৮ বছরে আর প্রতিবেশী সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ৩৪ থেকে ৪০ বছর। তো সারা পশ্চিম ও আশপাশে যখন চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা এ রকম, ফলে সেই সব দেশের আমলারা তো মেধাবী হবেনই। যোগ্য মানুষটি যখন চাকরিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবেন, তার সার্ভিসটাও নিশ্চয়ই সে অনুসারেই হবে। আর বাংলাদেশের তরুণরা যখন চাকরিতে প্রবেশের সময়টাই পেলেন না, তখন তাঁরা কী করবেন? বিকল্প লাইনই তো খুঁজবেন। নিজের চেষ্টায় যখন কিচ্ছু হবে না, তখন ফাঁস করা প্রশ্নেই তো উত্তর লিখবেন, শর্টকাট খুঁজবেন-এটাই তো স্বাভাবিক। আর এই শর্টকাটের ফলাফল আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, অথর্ব আমলাতন্ত্র এবং আজকের আমরা তো কথায় কথায় উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ দিতে পছন্দ করি, সেই দেশগুলোতে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমাটা জেনে নেওয়া যাক।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।