ধবলধোলাই
মাঠে একসারিতে আট টাইগার
ছবিটা পরের দিন পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছিল। ১৬ বছর আগের কথা বলছি। কী করে সম্ভব এমন দৃশ্য দেখানো!
এই ছবিটাও পরের দিন শিরোনাম হলো। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় আরো ভালোভাবে হলো। এমন দৃশ্য বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম জন্ম দিল, যা বিস্ময়ের জন্ম দেয়। যাঁরা খেলা দেখেননি, তাঁদের জন্য দৃশ্যটা ব্যাখ্যা করছি। বাংলাদেশের একজন ফাস্ট বোলার আটজন ফিল্ডার উইকেটের পেছনে রেখে ব্যাটসম্যানের উদ্দেশে দৌড় শুরু করেছেন! আহ! অসাধারণ!
আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে বড় বড় প্রতিপক্ষ এমন ফিল্ডিং সাজাত। ওয়ানডেতে অবশ্য নয়, টেস্টে। টেস্টেও এমন ফিল্ডিং সাজানো হরহামেশাই দেখা যায়। তবে সেটারও একটা মাত্রা আছে। পাঁচ-ছয়জন ঠিক আছে। তাই বলে আট-নয়জন! অবিশ্বাস্যই লাগে।
টেস্টে প্রায় সব ফিল্ডারকেই স্লিপে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার 'স্পর্ধা' আমরা স্টিভ ওয়াহ-রিকি পন্টিংয়ের মধ্যে দেখতে পেয়েছি অস্ট্রেলিয়ার 'স্বর্ণযুগে'। ওয়েস্ট ইন্ডিজের 'স্বর্ণযুগে' ক্লাইভ লয়েডের নেতৃত্বে যখন খেলতেন বিখ্যাত 'পেস কোয়াট্রেট', তখন এমনটা ভাবা যেত। সেই আমলে ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলারদের এমনই দাপট ছিল যে, পয়েন্টে ফিল্ডার রাখাকে পর্যন্ত 'লজ্জাজনক' ভাবতেন তাঁরা! ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলারদের 'স্কয়ার অব দ্য উইকেটে' শট খেলা হবে, এটাকে তাঁরা রীতিমতো অপমানজনক মনে করতেন। এমনই ছিল স্বর্ণযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
একটা ফিল্ডিং দল ব্যাটসম্যান বা ব্যাটিং দলকে কতটা আক্রমণ করছে, মানসিকভাবে শাসাচ্ছে, চাপে রাখার চেষ্টা করছে তার মানদণ্ডের হিসাবে ভাবা হয়, স্লিপে তারা কতজন ফিল্ডার রেখেছে। টেস্ট ক্রিকেটে এই 'মাইন্ড গেম'টা খুব উপভোগ্য এবং অনিবার্য। তবে ওই অঞ্চলে চার-পাঁচজন ফিল্ডার রাখলেই সাধারণত ধরে নেওয়া হয়, অধিনায়ক দারুণ আক্রমণাত্মক মেজাজে আছেন।
এই কথাটা বলা হচ্ছে টেস্টের ক্ষেত্রে। টেস্টের ধরনটাই এমন। এখানে আপনাকে প্রতিটি মুহূর্তেই পরীক্ষার মধ্যে থাকতে হবে। এ জন্যই বোধ হয় ক্রিকেটের প্রাচীনতম ফরম্যাটটির নাম 'টেস্ট'!
তাহলে একবার ভাবুন, ওয়ানডেতে যখন এই মাত্রার ফিল্ডিং সাজানো হয়, তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়। তাহলে আরো একবার ভাবুন, ওয়ানডেতে আট-নয়জন ফিল্ডার স্লিপ অঞ্চলে রণসজ্জায় রাখা হলে কী অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম হয়ে যায়!
ওয়ানডেতে এমন দৃশ্য প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৬ বছর আগে। উইজডেন অ্যালামনাক আপনাকে তাই জানাবে। দৃশ্যটা ১৯৯৯ সালের ২৩ অক্টোবর ঘটেছিল হারারেতে। স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এ ঘটনা ঘটিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেও কিন্তু তখন স্বর্ণযুগ। তার পরও ৯৮ রানে তাদের ৯ উইকেট নেই! ৩২.২তম ওভারের ঘটনা সেটা। একাদশ ব্যাটসম্যান ডেভিড মুতেন্দ্রেরা উইকেটে আসতেই ওয়াহ সব ফিল্ডারকে স্লিপে দাঁড় করিয়ে দিলেন। ওভারের বাকি চারটা বলে দৃশ্যটা অভিন্নই ছিল।
দৃশ্যটা ভাবুন, মাঠের বাকিটা অংশ ফাঁকা, সামনাসামনি শুধু ম্যাচসেরা খেলোয়াড়, বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিং ও ব্যাটসম্যান ডেভিড মুতেন্দ্রেরা! এ দৃশ্যটাই পরেরদিন পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়েছিল!
পরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়াই রঙিন পোশাকে এমন দৃশ্যের জন্মদাতা। ১৬ বছর পর বাংলাদেশও এমন দৃশ্যের জন্ম দিল।
৪২.২ ওভারে তিনাশে পানিয়াঙ্গারাকে ফেরালেন মুস্তাফিজুর রহমান। একাদশ ব্যাটসম্যান তাউরাই মুজারাবানি মাঠে ঢুকতেই নাকি নাসির হোসেন সবাইকে স্লিপে চলে আসার আহ্বান জানালে অধিনায়ক সেটাতে সায় দিলেন। তখন নাকি অধিনায়কের মনেও পড়েছিল, অস্ট্রেলিয়া একবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এমনটা করেছিল। ম্যাচ শেষের সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজা।
মাশরাফি অবশ্য স্টিভ ওয়াহর মতো নয়জনকে রাখলেন না। শুধু মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে রেখে দিলেন মিডঅফে, মানে রাখলেন আটজনকে। রিয়াদ ইতিহাসের অংশ হতে পারলেন না!
মাশরাফি স্টিভের মতো চার বলও দীর্ঘায়িত করলেন না দৃশ্যটা। ওই ওভারের তৃতীয় বলটি হয়ে যাওয়ার পরপরই আল-আমিন হোসেনকে পাঠিয়ে দিলেন মিডঅনে। আট থেকে সাতে নেমে এলো স্লিপ অঞ্চলে মানুষের সংখ্যা।
তাতে কী, আমরা তো সবাই ওই আটজনের সৃষ্টি করা দৃশ্যটাই মনে রাখব অনন্তকাল!
ওই দৃশ্যটা মনে রাখব কারণ, ওটা আমাদের ক্রিকেটে দিনবদলের সবচেয়ে বড় প্রতীকী দৃশ্য হয়ে গেছে!
আমরাও দাপট দেখাতে পারি, আমরাও আক্রমণ করতে পারি, আমরাও প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করতে পারি—এর প্রামাণ্য দলিল ওই দৃশ্য। ওই দৃশ্যে আমাদের গর্বিত হওয়ার, আনন্দিত হওয়ার অসংখ্য অনাবিল কারণ আছে বৈকি!
ক্রিকেটের গণ্ডিতে একদার ছোট বাংলাদেশ বড় হয়ে গেছে, সেটা আগেই প্রমাণ করেছি আমরা। ওই দৃশ্য নির্মাণ করে প্রমাণ করলাম, আমরাও সাম্রাজ্যের দাবিদার হতে চলেছি। আমাদেরও মানসিকতার বদল ঘটেছে। আমরাও এভাবে ভাবতে পারি। একসময়ের মহাপরাক্রমশালী অস্ট্রেলিয়া এভাবে ভাবতে পারে, বাংলাদেশও ভাবতে পারে। আহ, কী চমৎকার!
এ দৃশ্যই তো সফল একটা বছরের শ্রেষ্ঠ সমাপনী উদযাপনের প্রতীকী চিত্র! ভুলে গেলে চলবে না, যাঁকে কেন্দ্র করে ওই দৃশ্যের নির্মাণ করল বাংলাদেশ, তিনি মুস্তাফিজুর রহমান। বছরজুড়ে বাংলাদেশের দুর্দান্ত সাফল্যের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন এই তরুণ। বাংলাদেশেও একজন ফাস্ট বোলার আছেন, যাঁর বলে আট-আটটা স্লিপ রেখে প্রতিপক্ষকে চূড়ান্ত আক্রমণ করা যায়। কে ভেবেছিল কবে!
আমরা বদলে গেছি, সত্যই বদলে গেছি! এই বদলের অন্দরে গৌরব আছে। আনন্দ আছে। আছে গৌরবদীপ্ত আনন্দধারা!
লেখক : গবেষক ও সংবাদকর্মী ।