সড়ক দুর্ঘটনা : কমবে কখনো?
এবার ঈদুল আজহায় সড়ক, রেল ও নৌ-পথে মোট ২৪৪টি দুর্ঘটনায় ২৫৩ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৯০৮ জন। আর ঈদযাত্রায় কেবল সড়ক দুর্ঘটনাতেই প্রাণ গেছে ২২৪ জনের। সড়কে ২০৩টি দুর্ঘটনায় ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। রোববার (১৮ আগস্ট) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। গত ৬ আগস্ট থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ দিনে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
ডেঙ্গু আর চামড়ার খবরের আড়ালে চাপা পড়েছে ঈদের সময় সড়কে প্রাণহানির এসব খবর। খবর হয়েছে ঠিকই, তবে গুরুত্বহীনভাবে। সড়ক দুর্ঘটনার এই ধারাবহিকতা নিয়ে দেশজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্তু আমরা তো এমন এক শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছি যে ব্যবস্থায় মানুষকে পাত্তা দেওয়া লাগে না, মানুষের কল্যাণ চিন্তা করতে হয় না। আর সড়ক দুর্ঘটনা এমন এক বিষয় যেখানে বেশির ভাগ ভিকটিম দরিদ্র শ্রেণির, তাই এই খাতে নৈরাজ্যই নিয়ম।
বাস্তবতা এই যে, আমরা নিশ্চিত হতে পারি–এ দেশের পথে পথে খুন বন্ধ হবে না, সড়কে শৃঙ্খলা কখনো আসবে না। আসবে না এ কারণে যে সড়ক নিয়ন্ত্রণকারী পরিবহন খাতের বড় কারবারিরা তা হতে দিবে না। শৃঙ্খলাহীন সড়ক তাদের কাছে স্বর্গ, কারণ ফিটনেসবিহীন গাড়ি, আর লাইসেন্সবিহীন চালক নামের শ্রমিকরা তাদের জন্য অর্থের খনি।
গত বছর বাসের ধাক্কায় স্কুল পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে। গত বছর ২৯ জুলাই ওই দুর্ঘটনা হওয়ার পরে ছাত্র বিক্ষোভের খবর মূলত সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর প্রথম কয়েকদিন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও পরবর্তীতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয় ঢাকায়।
দেশজুড়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের এক বছর চলে গেছে। সরকারের দিক থেকে কত কত নির্দেশনা ছিল, কত কত প্রতিশ্রুতি ছিল। কত বড় জায়গা থেকেই বলা হয়েছিল শিক্ষার্থীরা নাকি চোখ খুলে দিয়েছে। কিন্তু চোখ আসলে আরো বেশি বন্ধ হয়েছে আমাদের। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন ছিল এ দেশে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেওয়া, সব শ্রেণির মানুষের প্রশংসা কুড়ানো একটি সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে অত্যন্ত পরিবল্পনামাফিক এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে যে হারে সড়ক দুর্ঘটনা হয় এবং এতে করে মানুষ মারা যায় ও পঙ্গু হয়, তা বিশ্বে বিরল। তাই মানুষ এখন আর এসবকে দুর্ঘটনা বলতে রাজি নয়। বলা হচ্ছে, পথে পথে খুন হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু কোনো প্রতিকারই মানুষ কখনো পায়নি। কলেজছাত্র রাজীব, গৃহকর্মী রোজিনা, কিংবা স্কুল শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পায়েলকে গলা ধাক্কা দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে, ইট দিয়ে নাক মুখ থেঁতলে নদীতে ফেলে হত্যা করলেও পরিবহন শ্রমিকদের কিছু হয় না। পরিবহন খাতের পেশিশক্তি সম্পন্ন মালিক-শ্রমিকরা আজীবন ক্ষমতা দেখিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেন আরো বেশি দেখিয়েছে। তারা রাস্তায় নেমে মানুষের, তথা জাতির মুখে কালো মোবিল লাগিয়ে দিয়েও নিরাপদে থেকেছে। সমালোচনা বা বিরোধিতা নিয়ে তারা মোটেই চিন্তিত ছিল না। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে এসব নৈরাজ্যকে সহযোগিতা দেওয়ার লোক ছিল তাদের। সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন মন্ত্রী, মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। এমন বাস্তবতায় সত্যিকার কোনো আইন বা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি সরকারের পক্ষে। আর বাংলাদেশের পরিবহন খাতই একমাত্র খাত যেখানে মালিক-শ্রমিক ঐক্য বিরাজমান নৈরাজ্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য।
এরশাদ জামানায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে রাজপথে যেমন ইচ্ছে তেমন করার অধিকার আদায়ের পর থেকে পরিবহন খাতের সব অন্যায় জাতিকে সইতে হচ্ছে।
গত বছর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে দুটো আইন সংসদে বেশ তড়িগড়ি করে পাস করা হয়। একই দিনে পাস হওয়া আইন দুটির একটি হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অন্যটি সড়ক পরিবহন আইন। সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক সমাজ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ জানালেও, প্রতিবাদ করলেও সরকার কারো কথা শোনেনি। দ্রুত আইনটি কার্যকর করেছে। তবে একইদিনে সংসদে পাস হওয়া সড়ক পরিবহন আইন এখনো কার্যকর করা হয়নি। সংসদে পাস হওয়া এই আইনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে সড়ক সংশ্লিষ্টরা অনেক কথা বললেও নতুন আইনকে প্রায় সবাই স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে, মানুষের মুখে কাল মোবিল লাগানোর আন্দোলনের কারণে এখনো এই আইন কার্যকর হয়নি। যে আইন কার্যকর হয়নি তারই সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে পরিবহন খাতের মাফিয়াদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে।
পরিবহন খাতে মালিক ও শ্রমিকদের একটা অংশের ভয়ংকর ঐক্য বিরাজমান। এরা সাধারণ শ্রমিকদের কোনো স্বার্থ দেখে না, শুধু এদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে। সাধারণ মানুষের সেবা ও নিরাপত্তা নয়, তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য শুধুই মুনাফা অর্জন। বাংলাদেশের পরিবহন শ্রমিকরা পৃথিবীর মধ্যে সব চেয়ে বেশি উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে এই মাফিয়াগোষ্ঠীর কারণে। মালিকদের বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি আর শ্রমিকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না।
জাতিকে সড়ক দুর্ঘটনার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে শক্ত হাতে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরতে হবে। এ জন্য গণপরিবহন খাতকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।