এরশাদের কোনো শাখা ছিল না

Looks like you've blocked notifications!

এরশাদ যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিলেন, তার বিনাশ নেই। গতকাল রোববার সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর এ কথাটিই বারবার মনে হচ্ছিল। অনেকে সেই চিরাচরিত বিশ্বাস থেকে বলেছেন, একজন মারা গেলে তার দোষ থাকলেও সেসব আর উচ্চারণ করা সৌজন্যতা নয়। আসলে তাঁরা করতে চেয়েছেন, কিন্তু করেননি। কারণ তাঁরা নিতান্ত হতাশ দেশের রাজনীতি দেখে।

এরশাদকে জনতা উৎখাত করেছিল। সেই ’৯০ সালে জনতার ধাওয়ায় ক্ষমতা ছেড়ে ৯০ বছরে বয়সে ক্ষমতার আরামেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর। জনতা যে পরিবর্তন চেয়েছিল, এরশাদের অবর্তমানে সেটা আর হয়নি। মানুষ স্বৈরাচার হটিয়ে গণতন্ত্র চেয়েছিল। কিন্তু এরশাদের পরে যে নির্বাচন হলো তাতে বিজয়ী বিএনপি হয়ে উঠল এক নির্বাচিত সরকার। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র থেকে বিএনপি দূরে ছিল।

মানুষ এরশাদ কর্তৃক পল্লবিত সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান চেয়েছিল। কিন্তু মানুষ দেখল, ’৯০-পরবর্তী নির্বাচনে বিজয়ী দল স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী দল জামায়াতকে সহযোগী করে সরকার গঠন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেই সরকারি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এবং ’৯০-পরবর্তী সময়ে সেই যে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করল যে রাজনীতি সে আরো বেশি সর্বগ্রাসী এবং সর্বব্যাপক। সেই থেকে মানুষের প্রশ্ন, এর জন্যই কি আমরা পরিবর্তন চেয়েছিলাম না এনেছিলাম?

ধর্মকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন এরশাদ। সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে, এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করে তাকে আরো প্রবল বাতাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মৌলিক কাঠমোকে বড় আঘাত করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন, এর মাধ্যমে দেশের নাগরিকদের সরাসরি মুসলিম ও অমুসলিম এই দুভাগে বিভাজিত করেছেন। এর মাধ্যমে সমাজে কেবলই ধর্মীয় বিভাজন। হয় এদিকে, না হয় ওদিকে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে রোববারের বদলে শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করেছেন। ধর্মের প্রতি কোনো ভালোবাসা থেকে নয়, এরশাদ এসব করেছেন নিজস্ব রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায়। ধর্মের প্রতি যার শ্রদ্ধা থাকে, তার ব্যক্তিগত চরিত্র থাকে সমালোচনার ওপরে। কিন্তু এরশাদের চারিত্রিক স্খলনের বৃত্তান্ত বলে শেষ করা যাবে না এবং তাঁর আমলেই দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।

আমাদের প্রজন্ম, যাঁরা আশির দশকের শুরুতে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া শুরু করেছিল, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না কীভাবে এরশাদ একটা প্রজন্মের শিক্ষাজীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলেন। এই প্রজন্মের সবার লেখাপড়া ও কর্মজীবন পিছিয়ে গেছে গড়ে প্রায় পাঁচ বছরের মতো। এরশাদের শাসনবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কত জীবন ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ঝরে গেছে, তার এক লম্বা তালিকা আছে ইতিহাসের পাতায়।

এরশাদ জাতীয় পার্টি নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই দলকে তিনি চালিয়েছেন। কিন্তু সুবিধাবাদ ছাড়া এই দলের কোনো আদর্শ নেই। নিজের সুবিধার জন্য যা যা করা দরকার, এরশাদ বারবার সেই কৌশলই অবলম্বন গ্রহণ করেছেন। আর এভাবেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েও কূটকৌশলে বারবার ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করেছেন। এরশাদের অবর্তমানে বিলুপ্ত হতে সময় লাগবে না এই দলের।

এরশাদের কৌশলের কাছে হারতে হয়েছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মতো বড় দলকে। বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে রেখে চেষ্টা করেছে এরশাদকেও না ছাড়তে। যে এরশাদকে বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে বরাবার অভিযোগ করা হয়েছে, সেই এরশাদকে দলে ভেড়াতে তাঁর বাসায় পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপি যে পথে হেঁটেছে, সেই পথে হাঁটতে বাধ্য হয়েছে আওয়ামী লীগও। যে এরশাদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের দল ফ্রিডম পার্টি গঠনে ও বিস্তারে অর্থায়ন করেছেন, তাদের সংসদে এনেছেন, তাদের পত্রিকা দৈনিক মিল্লাত প্রকাশে সাহায্য করেছেন, সেই এরশাদ তাঁর জাতীয় পার্টিকে নিয়ে পরে হয়ে গেলেন শেখ হাসিনার সরকারের অংশ।

আসলে এরশাদ ছিলেন সুবিধাবাদী রাজনীতির খুচরা এবং পাইকারি বিক্রেতা, তার কোনো শাখা ছিল না। ১৯৭১-এর পর এরশাদকে হটিয়ে বাংলার মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আবার তারা পাবে উদার ও গণতান্ত্রিক এক বাংলাদেশ। কিন্তু তা হয়নি। এরশাদের কূটকৌশল আর বড় দুই দলের ক্ষমতার মোহে মানুষের স্বপ্ন তাসের ঘরের মতো লুটিয়ে পড়েছে দ্রুত।

এরশাদ অবকাঠামোগত অনেক কাজ করেছেন তাঁর শাসনামলে। উন্নয়ন এখনো একটি বড় স্পৃহা। কিন্তু সমাজের উন্নয়ন, শিল্পায়ন, সাংস্কৃতিক বিকাশ সব নষ্ট হলে আর কোনো উন্নয়ন কি কাজে লাগে? এরশাদ সাম্প্রদায়িক ছিলেন। ছিলেন কর্তৃত্ববাদী শাসক। রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে রাজনীতির মননে অবচেতনে সুপ্তসত্তা হয়ে গেছে এই বিষ। এরশাদ যে ধারার কর্তৃত্ববাধী ছিলেন সেই ধারায় বহুত্ববাদকে, অন্য মতকে সহ্য করার ক্ষমতার স্থিতিস্থাপকতার সীমানা চূর্ণ করে দেয়। গণতন্ত্রের জমানায় এরশাদের সরব উপস্থিতি সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে।

সমাজে বিচরণকারী সুবিধালোভী ও সুবিধাভোগীদের চিনেছিলেন এরশাদ। আর সেই পথ ধরেই সেয়ানা, লোভী, কৌশলী, সুযোগলোভী উপমধ্যশ্রেণি এ দেশের শাসন ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। এরশাদ এখানেই অতুলনীয়।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।