ধর্মীয় সংকীর্ণতায় মুক্তি নেই বাংলাদেশের

Looks like you've blocked notifications!

কাল পহেলা জুলাই, গুলাশানের হলি আর্টিজানে ভয়াল জঙ্গি হামলার তিন বছর হবে। ২০১৬ সালের সেই দিন, রোজার মাস শেষ হতে সপ্তাহ খানেক বাকি। অসংখ্য বিদেশি আর দেশি মানুষজন এই জনাকীর্ণ রাজধানীর সবচেয়ে সুন্দর ক্যাফেতে বসে সন্ধ্যাটি উপভোগ করছিল। হঠাৎ কি এক হাওয়া এসে ক্যাফেতে সন্ধ্যার শান্তি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। একদল জঙ্গি নির্মমভাবে কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করে শুভ্র মানুষদের। বিশ্বব্যাপী তারা আলোচনায় নিয়ে আসে বাংলাদেশকে। পশ্চিমা বিশ্বের গণমাধ্যম আনন্দিত হতে থাকে এই ভেবে- যেন পাওয়া গেছে আরেক সিরিয়া বা ইরাক।

হামলাকারীরা পরাজিত হয়, পরাজিত হয় দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারী শক্তি। বাংলাদেশের সামাজিক হিংসার বিস্তার ঘটানোর চক্রান্ত পরাজিত হয়। সেই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন তার সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে, তেমনি সাধারণভাবে জঙ্গিবিরোধী একটা জাতীয় ঐক্যও আমরা অনুভব করছিলাম। গত তিন বছরে দেশের মানুষ আইনশৃঙ্খল বাহিনীর সাফল্যে যেমন আশার আলো দেখেছে, তেমনি জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে কুৎসিত রাজনীতি দেখতে হয়েছে।

গুলশানেই থেমে ছিল না। এরপর একের পর এক জেলা, দেশের নানা প্রান্তে জঙ্গিদের পদচারণায় প্রকম্পিত হয়েছে। সক্ষমতার সঙ্গে সেসব হামলা বা হামলার প্রস্তুতি প্রতিরোধ করেছে, প্রতিহত করেছে আমাদের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

দীর্ঘ সময় ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের মগজ ধোলাই করা হয়েছে, তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জিহাদের কল্পনা ও ইসলামি মৌলবাদী দর্শনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে তরুণরা এমন ভয়ংকর পথে পা বাড়াচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বিস্তার এক কারণ তো আছেই, কিন্তু সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে ধর্ম ব্যবসায়ীদের ছড়ানো ঘৃণার সংস্কৃতি। সিরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে তার ছায়া বিস্তার করেছে। আমাদের বাহিনীগুলো প্রশ্নাতীতভাবে তাদের সাফ্যল্য দেখিয়ে চলেছে। আশা করছি, আগামীতেও তাদের সাফল্যের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু জঙ্গিবাদের ঝাপটা ও সহিংস চরমপন্থা প্রকৃত অর্থে দূর করতে হলে তাদের আদর্শিক মূল উপড়ে ফেলার কাজটাই করতে হবে।

বাংলাদেশে জিহাদি সংগঠন বিস্তারে পৃষ্ঠপোষকতায় বড় ভূমিকা রেখেছে রাজনীতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। এর পেছনে আবার আছে বিদেশি অর্থ। এরই সরাসরি ফল আজকের জঙ্গিবাদ যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এক গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধর্মীয় উগ্রবাদকে রাজনৈতিক কারণে সব সরকারই দেখেও না দেখার ভান করেছে। বরং কোনো কোনো সরকার সরাসরি এদের পদ-পদবি দিয়ে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পুরোনো হলেও যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর থেকে দেখা গেছে পাকিস্তানি কায়দায় ধর্মীয় উপদলীয় কোন্দল তৈরির চেষ্টা হচ্ছে যা আরো ভয়ঙ্কর করে তুলছে পরিস্থিতিকে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটাই এখন প্রধান হুমকি।

গুলশান ক্যাফে হামলা ছিল এমন এক ঘটনা যে ঘটনা বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। যে বাংলাদেশ আমরা আবহমান কাল থেকে দেখে আসছি, যে বাংলাদেশের জন্য আমরা যুদ্ধ করেছি, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে, সেই বাংলাদেশে অনেক রক্ত ঝরেছে ঠিক, কিন্তু এই গুলশান হামলা ছিল সব ঘটনা থেকে আলাদা। এই উদার বাংলাদেশকে বারবার সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা করেছে রাজনীতি, যার চূড়ান্ত আঘাত ছিল হলি আর্টিজানে হামলা। উদ্দেশ্য ছিল, এ দেশকে পাকিস্তান দর্শনে ছেয়ে ফেলা। হামলাকারীরা মারা গেছে, কিন্তু তারা সফল হয়েছে অন্যভাবে। সেই হামলার পর যেন, সমাজ আরো বিভাজিত ও কলুসিত হয়েছে, ধর্মীয় রাজনীতির বিষে আক্রান্ত হয়েছে।

গুলশান হামলার পর জঙ্গি ও সন্ত্রাসী খতমে বড় সাফল্য দেখিয়েছে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুঃখজনক হলো কোথায় জাতীয় ঐক্য দেখব আমরা, তা নয়, বরং এই সাফ্যলকে কালিমালিপ্ত করতে চেষ্টা করেছে আমাদের এখানে সদা ষড়যন্ত্র তত্বে বিশ্বাসী সরকারবিরোধী রাজনীতি। বিরোধিতার প্রচলিত ছকের বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে না শেখায় আমাদের রাজনীতিকরা দেশের ভেতরেই নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিনাশকারী শক্তিগুলোর মাঝে নিজেদের ঠিকানা খুঁজছে। কোনো সন্দেহ নেই সেই সন্ত্রাসীরা কারো না কারো মদদে এই কাজ করেছে।

গুলশান হামলার অন্যতম লক্ষ্য রাজনৈতিক সহিংসতা আমদানির পাশাপাশি শিল্প ও বাণিজ্যকে বিদায় জানানো। তারা উল্লসিত হতে চেয়েছিল যেন প্রগতির পথ, উন্নয়নের পথ থেমে যায়। তাই তো হয়েছিলও কিছুটা। একের পর এক আঘাত এসেছিল ব্যবসা বাণিজ্যে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আবার জোর কদমে চলেছে উন্নয়নের চাকা। এত রক্ত, হিংসা আর আগুনের পরও উচ্চ প্রবৃদ্ধি, মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন। 

এ কথা সত্য, যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে সংঘাত ও হিংসা পুরোপুরি দূর করা যায় না। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি, ব্যক্তি বনাম গোষ্ঠী, গোষ্ঠী বনাম গোষ্ঠী, সম্প্রদায় বনাম সম্প্রদায়, এসব নানা ভাবে সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এসব দ্বন্দ্ব নিরসন করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে চলতে হয় বহুপক্ষীয় পথে। কোনো গোষ্ঠী, ধর্মীয় বা অন্যকোনো সংখ্যাতত্বের জোরে যেন নিরঙ্কুশ সুবিধা ভোগ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। যারা বারবার ধর্মীয় সংখ্যার আধিক্য দিয়ে সব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর চাপাতে চায়, রাষ্ট্র থেকে আদায় করতে চায়, তাদের সেই মনোভাবের মধ্যেই আছে সহিংসতার সব থেকে বড় সম্ভাবনাময় উৎস।

গুলশান হামলার পর এটাই চ্যালেঞ্জ বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে। ধর্মীয় সংকীর্ণতায় মুক্তি নেই বাংলাদেশের। বাংলাদেশের মুক্তি অসাম্প্রদায়িক পথে। সহিংসতার আধিপত্য বিস্তারের সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতেই হবে আমাদের। ‘যাকে তাকে যখন তখন মুরতাদ, নাস্তিক যারা বলে তারা দেশ বিরোধী’, এই মন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে সবার আগে। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে এটাই হোক নতুন অঙ্গীকার।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা।