বিশ্বকাপ ক্রিকেট

বাংলাদেশ আর কাউরে ডরায় না

Looks like you've blocked notifications!

দক্ষিণ আফ্রিকা বরাবরই শক্তিশালী টিম, র‍্যাংকিংয়েও বরাবর ওপরের দিকেই থাকে। কিন্তু তারা দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলুক, ছোটখাটো টুর্নামেন্ট খেলুক। বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে তাদের আসাই উচিত না। বারবার সমর্থকদের স্বপ্ন দেখিয়ে, বারবার তাদের বুক ভেঙে দেওয়ার কোনো অধিকার দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের নেই। এবারের বিশ্বকাপ শুরু থেকেই পূর্ব প্রত্যাশা অনুযায়ী চলছে। মাঝ বরাবর এসে বিশ্বকাপকে একতরফা, বোরিং লাগছে। সব ফরম্যাট আর প্রেডিকশন অনুযায়ী হলে বিশ্বকাপ আয়োজনেরই বা কী দরকার? এই বোরিং বিশ্বকাপে এক্সাইটমেন্ট সৃষ্টির এবং আফগানিস্তান ছাড়া বাকি সবার জন্য টুর্নামেন্টটি ওপেন করে দেওয়ার একটা দারুণ সুযোগ ছিল তাদের এবং নিদারুণভাবে সে সুযোগ তারা হেলায় হারিয়েছে।

বুধবারের ম্যাচের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড এবং তিন মোড়ল— ভারত, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ছাড়া ক্রিকেটবিশ্বের নিপীড়িত অংশের সবাই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে। কিন্তু সে সমর্থনও তাদের 'চোকার' অপবাদ ঘোচাতে পারেনি। নিজেদের বিদায় তো প্রায় নিশ্চিত করেছেই, বাংলাদেশসহ অন্য দলগুলোর সেমিফাইনাল স্বপ্নও ধূসর করে দিল। তবু অনিশ্চয়তা না থাকলে ক্রিকেটের গৌরব থাকে কীভাবে? আজ বাংলাদেশের দায়িত্ব বিশ্বকাপকে রোমাঞ্চকর করে তোলার। বাংলাদেশের এখন আর কোনোদিকে তাকানোর সুযোগ নেই। ম্যাচ বাই ম্যাচ আগাতে হবে, জিততে হবে সবগুলোই।

আমরা লিখি, কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন লেখা উচিত, প্রায় অসম্ভব কিন্তু পুরো অসম্ভব নয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের সাফল্যের ট্রেন দারুণ গতি পেয়েছে। কিন্তু সেই ট্রেনের সামনে আজ প্রবল বাধা অস্ট্রেলিয়া। মানছি, কাগজে-কলমে অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু ক্রিকেট বেশিরভাগ সময়েই কাগজ-কলমের হিসাব মেনে চলে না। চললে ক্রিকেট হতো সবচেয়ে বোরিং খেলা, অনিশ্চয়তা না থাকলে আর ক্রিকেটের গৌরব কি?

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আমাদের একমাত্র জয়ের স্মৃতি ১৪ বছরের পুরোনো, কার্ডিফে সেই আশরাফুল রূপকথা। এখনকার ছেলেরা নিশ্চয়ই সুখস্মৃতির জন্য অত পেছনে যেতে চাইবে না। এটা শুধু সমর্থকের আশাবাদ নয়; মাঝের ১৪ বছরে, বিশেষ করে গত চার বছরে বাংলাদেশ বদলে যাওয়া দল। নিজেদের দিনে বাংলাদেশ হারিয়ে দিতে পারে যে কাউকেই। আরেকটা কথা বলি, তিন মোড়লের মধ্যে অস্ট্রেলিয়াকেই আমার সবচেয়ে নড়বড়ে লাগছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ অমন পিকনিক মুডে বিশ্বকাপ খেলতে না এলে সেদিনই অস্ট্রেলিয়া হেরে যেত। আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, অমন বাগে পেলে বাংলাদেশ কাউকে ছাড়বে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ধাক্কা দিয়েছে, এখন বাংলাদেশের কাজ ক্যাঙারুদের কাবু করা। কাগজে-কলমে অস্ট্রেলিয়ার ৯ নম্বর পর্যন্ত ব্যাটসম্যান। বোলিং-ফিল্ডিংটাও দারুণ। কিন্তু তাতে আমরা ছেড়ে কথা বলবে না।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পাঁচ ম্যাচ গেছে। তার মধ্যে বৃষ্টি বাংলাদেশের একটি পয়েন্ট কেড়ে নিয়ে শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দিয়েছে। বাকি চার ম্যাচেই আমাদের ব্যাটিং গভীরতা টের পেয়েছে সবাই। প্রথম ম্যাচেই ওয়ানডেতে নিজেদের সর্বোচ্চ ৩৩০, পঞ্চম ম্যাচে ৩২২-এর টার্গেটে পৌঁছে গেছি ৪১.৩ বলে। অথচ এক সাকিব ছাড়া আর কেউ কিন্তু ধারাবাহিক নন। তবে সুখের কথা হলো, বাকিদেরও ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত পাচ্ছি। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে রানআউট হওয়ার আগে তামিম যে ৪৮ রান করেছেন; তাতেই ছিল আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া, ব্যাটে ছিল দারুণ ছন্দ। বিশ্বকাপে ভালো কিছু করতে হলে তামিমকে লাগবে, এই স্বপ্ন যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের আরেকটু অপেক্ষা করতে বলছি। আমার বিশ্বাস, তামিম ফাটিয়ে দেবে যেকোনোদিন।

সৌম্য-লিটনরা বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সাইনবোর্ড; তাতে লেখা আছে,  এখানে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলা হয়। এই কলামটি যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা জানেন, দ্বিতীয় ম্যাচ থেকেই আমি মিঠুনের জায়গায় লিটনকে নামানোর দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সৌম্য প্রতিবারই ঝড় তুলছেন। তবে তাঁকে ঝড়টা আরেকটু বড় করতে হবে। সাকিবকে নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। প্রতিপক্ষ কে, সেটা নিয়ে ভাবেন না। ইংল্যান্ডের সঙ্গে হারা ম্যাচেও সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। সাকিব আসলে বিশ্বমানের ক্রিকেটার নন। তার চেয়েও বেশি কিছু। মুশফিকের কাছে আমাদের অনেক ঋণ, অনেক প্রত্যাশা। তাঁকে নিয়েও বলার কিছু দরকার নেই। গত বিশ্বকাপে ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহও এখন দেখাতে পারেননি। প্রয়োজনে মিরাজ, মোসাদ্দেক, সাইফউদ্দিনও ব্যাট করতে পারেন। অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে বোলিং দারুণ বৈচিত্র্যময়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভয়ংকর ব্যাটিং লাইনআপ মাশরাফি-সাইফউদ্দিনের কাছ থেকে মাত্র ৩২ রান তুলতে পেরেছে। মুস্তাফিজ সময়মতো জ্বলে উঠছেন। সাকিব-মিরাজের ঘূর্ণিও দারুণ। সব মিলিয়ে পারফেক্ট টিম।

তবে ব্যাটিং বা বোলিং নয়; আমি পার্থক্য বুঝি ফিল্ডিংয়ে। প্রথম ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারালেও সেদিন বাজে ফিল্ডিং হয়েছে। পরের দুই ম্যাচেও ফিল্ডিং তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আবার অন্যরকম চনমনে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বদলে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হবে ফিল্ডিংয়ে আর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো ম্যাচে পাওয়া মোমেনটাম।

বাংলাদেশের এখন ‘আগাতে হলে, জিততে হবে’ পরিস্থিতি। ক্রিকেটাররা ‘ডু’ না করলে কিন্তু আমরা ‘ডাই’ হয়ে যাব। একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে একটা গল্প পড়েছিলাম। ঝড়ের সঙ্গে এক গ্রামের লোকের লড়াইয়ের গল্প। বারবার ঝড় আসে, আর সব লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মাথার ওপরে আকাশ চলে আসে। একবার সবাই মিলে, শক্ত করে ঘর বাঁধল। এরপর ঈশান কোণে মেঘ দেখে এক গ্রামবাসী বললেন, আসুক তুফান, তুফানরে আর ডরাই না। বাংলাদেশও এখন আর কাউরে ডরায় না।

সাংবাদিক ও কলাম লেখক