নববর্ষ
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
বায়ুকোণে আকাশজুড়ে কৃষ্ণমেঘের ঘনঘটা। চকিতে বিদ্যুতের ঝলক আর গুড়ুম গুড়ুম আবহসংগীত। মেঘের ক্যানভাস পশ্চাতে রেখে কৃষচূড়ার গাঢ় লাল। আম্রশাখে লোকায়িত ঝিঁঝিপোকাদের হর্ষচিৎকার। সবুজ ধানের ক্ষেতের পাশে নবজলের বিল। সেই বিলের জলে পানকৌড়িদের ছন্দোবদ্ধ ডুবসাঁতার। বিলের পাশে দূর্বাঘাসের মাঠ। দূর্বার কচিপত্রদের সুখের বৃষ্টিস্নান। সঙ্গে লজ্জাবতীর গোলাপি পুষ্পের সলাজ হাসি। এমনতর মাঠের সীমানায় বয়সী বটবৃক্ষের নিচে শখের মেলা। রঙিন পোশাক পরা এলাকার সব বয়সী বাসিন্দার মনে আজ উৎসবের আমেজ। লালপেড়ে সফেদ শাড়িতে শিশুর হাত ধরে রাখা গ্রাম্যবালার লাজুক মুখচ্ছবি। মেলাজুড়ে গ্রামের মৃৎশিল্পীদের পণ্য, বাঁশ ও বেতশিল্পীর কাজ, বিন্নি ধানের খই, সাজ-বাতাসার হরেকরকম পসরা। আছে ভর্তাভাজির সঙ্গে পান্তাভাত, কাঁচামরিচ আর পেঁয়াজের অমৃত আস্বাদ।
শিশুদের হাতে বাঙালিয়ানার পরিচয়বাহী মুখোশ ও রংবেরঙের কাগুজে পাখা। বণিকদের ঘরে ঘরে হালখাতা উপলক্ষে বাহারি মিষ্টান্নের রসনাবিলাস। সব আয়োজনে সর্বমানুষের সমান সমাগমে আবার নূতন করে ভালোবাসা লেনাদেনার আত্মিক সম্মিলনী। শোকতাপ, বেদনা, অপ্রাপ্তি ও আক্ষেপের আজ ছুটি। দুঃখদের বিদায়ঘণ্টা আগেই বাজিয়ে রাখা হয়েছে। সুখপরীদের নৃত্যগীতে উন্মাতাল মহাপ্রকৃতিও। আজ আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর। এটা তবে বৈশাখেরই স্মারকচিহ্ন? শুভ নববর্ষ ১৪২৬।
বছরের শেষ গান সাঙ্গ করে পুঞ্জ পুঞ্জ রূপে গগন পূর্ণ করে নূতন এসেছে। পুরাতন পর্ণপুট দীর্ণ বিকীর্ণ করে, জীর্ণ পুষ্পদল চতুর্দিক ধ্বংস ভ্রংস করে অপূর্ব আকারে যেমন ফল বের করে, তেমনি সবলে আজ নূতনের আগমন ঘটেছে। এই অমোঘ নূতনেরে প্রার্থনাভরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো করেই প্রণাম জানাই :
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ
তোমার ফুৎকারলুব্ধ ধুলা-সম উড়ুক গগনে,
ভ'রে দিক নিকুঞ্জের স্খলিত ফুলের গন্ধসনে
আকুল আকাশ—
দুঃখ সুখ আশা ও নৈরাশ।
বছরজুড়ে অনিরাপদ সময়কে সঙ্গী করে মানুষের যাপিত জীবন বয়ে চলে এক অনিশ্চিত নিরুদ্দেশ পানে। হাজার গ্লানিকে বয়ে বেড়াতে হয় আপামর জনসাধারণকে। কখনো সড়ক দুর্ঘটনা, কখনো অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি—এমন একটার পর একটা দুঃখ এসে নোঙর করে আমাদের রোজকার সুশান্তির কল্পিত বন্দরে। নানা অপঘাতে স্বজন হারানোর ব্যথা কুড়ে কুড়ে খায় নিঃস্ব মানুষকে। আজকের দিনের শপথ যদি এমন হতো অতীত কৃষ্ণকায় দিন আর ফিরতে দেব না প্রাণের বাংলাভূমে। মানুষের দেশে মানুষের ভালোবাসায় প্রশান্তি ফিরবে পোড়খাওয়া এই জনপদে—এমন অঙ্গীকার পূর্ণতা পেত যদি?
বিগত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বজুড়ে কিছু মানুষ ধর্মের নামে ঘৃণার আবাদ করে যাচ্ছে। এতে যৎসামান্য পানি ঘোলা হচ্ছে। উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে। নিজেদের জ্ঞাতিগোষ্ঠীই মারা পড়ছে। কিন্তু এখনো সাধারণ মানুষের মনন ও মগজে সর্বমানুষে ভালোবাসারই চাষবাস।
চেষ্টা চলছে, দেশের মানুষ হাজার বছরের বাঙালিয়ানার শেকড় ভুলে যাক। কিন্তু মহুয়া, মলুয়া, কমলা, কাজলরেখার মতো পালাগানের সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে আমাদের। সর্বমানুষের পূজারি মিস্টিক কবি লালন ফকিরের গান আমাদের সংস্কৃতির অনন্য সম্পদ। হাসন রাজা, রাধারমণ আর শাহ আবদুল করিমের মতো অমৃত সুরের সাধকদের বসবাস আমাদের হৃদয়জুড়ে। জারি-সারি-ভাটিয়ালি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
রক্ষণশীলতা আর একমাত্রিক জ্ঞানচর্চা মানুষের অপার সম্ভাবনা রহিত করে। বহুমত ও পরমতসহিষ্ণুতা বিনষ্ট করে। এই আধুনিককালে বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ ও মুক্তমতের স্বাধীনতাই এখন বিশ্বজুড়ে সবার আরাধ্য। এমন সময়ে মানুষে মানুষে ঘৃণার উদ্রেক করা ধ্যানধারণা নিশ্চিতই নিপাত যাবে। নইলে মানুষ হিসেবে আমাদের মুক্তি নেই।
নূতন বছরে বাংলা থেকে দূরীভূত হোক বিচারহীনতার সংস্কৃতি। খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, লুটপাটের মতো বর্বরতা অপসৃত হয়ে সভ্যতা ফিরুক এই ভূমিতে। নুসরাত জাহানের অকাল প্রয়াণের মতো ট্র্যাজিক ঘটনা এই বাংলায় আজন্মে আর না ফিরুক। ডেভিলসত্তাকে মুছে ফেলে সম্মান ও মর্যাদায় বাঁচুক বাংলাদেশের সকল মানুষ। সকল ভয়কে জয় করে পুরুষের সঙ্গে সমান্তরালে এগিয়ে থাকুক আমাদের মা ও বোনেরা। আজ শুভ নববর্ষে কবিগুরুর আকুতিই আরেকবার পূর্ণতা পাক :
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,
আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।
মায়ার কুজ্ঝটিজাল যাক দূরে যাক।।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।