দৃষ্টিপাত
‘অগ্নিমানব’ সোহেল রানার মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন
নাম তাঁর সোহেল রানা। বয়স কত হবে? বড়জোর ২৫ কি ২৭? জীবিকার তাগিদে চাকরি নিয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিসে। আর দশটা চাকরির মতো ফায়ার সার্ভিসের চাকরি এক নয়। আগুন লাগলে সবাই যখন জীবন নিয়ে দৌড়ে পালায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা করে ঠিক তার উল্টো। আগুন লাগলে তাঁরা দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন আগুনে। আগুন নেভাতে, আগুনে আটকেপড়া মানুষের প্রাণ বাঁচাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন তাঁরা। সোহেল রানাও তাই করেছিলেন।
বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের দিন অন্যান্য ফায়ারম্যানের মতো তিনিও পেশাগত দায়িত্ব পালনে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। জীবনের মায়া তুচ্ছ করে শরীরের ওপর ঝুঁকি নিয়ে লেডার (স্বয়ংক্রিয় মই) দিয়ে উদ্ধার করে আনছিলেন আটকেপড়া মানুষ। কিন্তু ওই যে! আমাদের অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেডারে সর্বোচ্চ চার থেকে ছয়জন লোক ধরে। এ রকমই একটি লেডারে করে সোহেল রানা এবং আরো দুজন ফায়ারম্যান আটকেপড়া কয়েকজনকে উদ্ধার করেন। কিন্তু জায়গা হচ্ছিল না লেডারে। আটকেপড়াদের জায়গা করে দিতে সোহেল রানা লেডারের সিঁড়ি দিয়ে নিচের দিকে নেমে আসছিলেন। কিন্তু লেডার তো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিচে নেমে আসে। তারই চাপে পড়ে সোহেল রানার পা মইয়ের ভেতর আটকে পড়ে কয়েক টুকরো হয়ে যায় ভেঙে! চাপ লেগে ছিদ্র হয়ে যায় তাঁর পেট! প্রাণ বাঁচাতে গিয়েছিলেন যিনি, তাঁরই প্রাণ বিপন্ন হয়ে গেল!
দেশের চিকিৎসা ব্যর্থ হওয়ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিঙ্গাপুরে। সেখান থেকেও এলো ব্যর্থতার খবর। সোহেল রানা সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রাণ বাঁচাতে উৎসর্গ করে গেলেন নিজের অমূল্য প্রাণখানি। এই যে সোহেল রানা চলে গেলেন, তাঁর প্রাণের এই যে অপূরণীয় ক্ষতি, সেই ক্ষতি পোষানো হবে কী দিয়ে? কী দিয়ে শোধ করা হবে সোহেল রানার পরিবারের ঋণ?
অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলা করতে গিয়ে ফায়ারম্যান সোহেল রানার মৃত্যু বেশকিছু সাধারণ অথচ নির্মম প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে। সোহেল রানার মৃত্যু কি দুর্ঘটনা নাকি দক্ষ-সরঞ্জাম সংকটের ফল? প্রয়োজনীয় অত্যাধুনিক সরঞ্জামের এই ঘাটতি কেন? আমাদের ফায়ার সার্ভিসের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা হবে কবে? যেকোনো অগ্নিকাণ্ডের সময় আমরা দেখি, আমাদের ফায়ারম্যানরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামান্যতম সরঞ্জাম নিয়ে স্রেফ মানবিক তাগিদে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন পরিস্থিতি মোকাবিলায়। যদিও এটা তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব, কিন্তু এত স্বল্পদক্ষতার সরঞ্জাম নিয়ে অগ্নিমোকাবিলার যে লড়াই, তাকে কেবল পেশাগত দায়িত্বের কাতারে ফেলা উচিত নয় কোনোভাবেই। পেশার চেয়েও বড় মনে করে তাঁরা কাজ করেন। শক্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ ছাড়া এইভাবে প্রায় শূন্যহাতে আগুন নেভাতে ঝাঁপিয়ে পড়া প্রায় অসম্ভব বলেই মনে করি। এই যে তাঁরা লড়াই করছেন, এই প্রাণ তুচ্ছ করে দাঁড়াচ্ছেন প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের সময়, এটাই কি শেষ কথা? তাঁদের অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে কবে? আর কত দিন তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সনাতনী কায়দায় আগুন নিভিয়ে যাবেন?
এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের সময় একজন ফায়ারম্যানের করা অনস্পট একটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আমরা দেখেছি। সেই ভিডিওতে তিনি বলছেন, তাঁদের চেয়ে মাত্র দশ কি বারো হাত আগে একজন লোক আটকা পড়ে আছেন। কিন্তু তার কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে প্রযুক্তি নিয়ে তাঁরা গেছেন, সেটাতে আর সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি মিনতির গলায় সরকারের কাছে আহ্বান করছেন ফায়ার সার্ভিসের সমর-সরঞ্জাম আধুনিকায়নের। উন্নত প্রযুক্তি হলে এ রকম বড় বড় বিপদে তাঁরা আরো দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবেন।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অগ্নিকাণ্ডের হার যে পরিমাণ বেড়েছে, তাতে ফায়ার সার্ভিস আধুনিকায়ন সময়ের অন্যতম জরুরি দাবি। যেকোনো উপায়েই হোক ফায়ার সার্ভিস বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রীর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শুধু ফায়ারম্যানদের কাঁধের ওপর ভর দিয়ে বসে না থেকে এই সেবা আধুনিকায়ন করতে হবে যেকোনো মূল্যে। অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের মতো এই কাজও সরকারকেই করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না হলে প্রয়োজনে দেশের মানুষের কাছে সহযোগিতা চাইতে হবে। দেশের মানুষ নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানও দিতে পারবে। এ জন্য দরকার যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যকর পদক্ষেপ। এবং তা যত দ্রুত সম্ভব। সোহেল রানার মতো অকুতোভয় ফায়ারম্যান আর একজনও আমরা হারাতে চাই না। আমরা এই বাহিনীর আধুনিকায়ন চাই। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করে দক্ষতা বাড়াতে চাই।
পরিশেষে বনানী অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ উৎসর্গকারী সোহেল রানার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করতে চাই। ফায়ারম্যান সোহেল রানা, আপনি সত্যিই একজন অগ্নিমানব। অবলীলায় প্রাণ তুচ্ছ করার মতো দুর্দান্ত সাহসী একজন মানুষ আপনি। মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রাণ বিসর্জনের এই যে নজির স্থাপন করলেন আপনি, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আপনার প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানাই। মহান আল্লাহ আপনাকে শহীদ হিসেবে আত্মত্যাগের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।