পাঠকের কলাম
পঞ্চদশ সংশোধনী ও কিছু ভাবনা
১.
অনেক 'যদি' নিয়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী মহল এখন চিন্তিত! কী সেসব যদি? যদি বর্তমান অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ২০১৯ সালেও একই ধরনের নির্বাচন দেখা যাবে? যদি আওয়ামী লীগ ততদিন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে, তাহলে কি বিএনপি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? আর বিএনপি যদি নিশ্চিহ্ন হয়, তাহলে সেই শূন্যস্থান কে পূরণ করবে? এমন হাজারো ‘যদি’ এখন ঘুরপাক খাচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের মাথায়।
আর আমজনতা বলে যাঁদের ব্রাত্য বলে পাশে ঠেলে দিয়েছি, তাঁদের মাথায় নির্মলেন্দু গুণের 'হুলিয়া' কবিতার সেই শেষ লাইনগুলো শব্দ পাল্টে এ রকমভাবে খেলা করছে—আমাদের ভবিষ্যৎ কী, বিপ্লবীরা এখন কোথায়? আমাদের চোখের সামনে আর কতকাল অন্ধকার ঝুলে থাকবে?
আর এই ঝুলে থাকা অন্ধকার সহসা কেটে যাওয়ার সহজ তরিকা সামনে নেই। অনেকে সরল যুক্তি ও অভিজ্ঞতা থেকে সেনাবাহিনীর কথা মুখে না বললেও মনে মনে বলে থাকেন। বিএনপিপন্থী অনেকের মধ্যে এটা দেখা যায়। কিন্তু যাঁরা জানেন সংবিধান কী বস্তু, তাঁরা মানবেন এই পথে বাংলাদেশের মুক্তি ঘটবে না। তাহলে মুক্তির মন্দিরের সোপানটা কেমন হবে?
২.
বাংলাদেশে যত সামরিক শাসন এসেছে, তা এসেছে সংবিধানের আওতাতেই। অর্থাৎ একেকটি সংশোধনী আরেকটি সংশোধনীকে বৈধতা দিয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী হয়ে গেছে শেষ ও চিরস্থায়ী সংশোধনী। এই সংশোধনী বলে সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ ও একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদ অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে। অর্থাৎ হাসিনা সরকার নিজে চাইলেও আর এই ধারাগুলো পাল্টাতে পারবে না। যদি পাল্টায়, তাহলে ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার ৭ক(১) ধারা অনুসারে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করতে পারে—এ জগতে কে কাহার! ফলে বর্তমান সরকারও এক দোধারী তলোয়ারের নিচে আটকা পড়ে গেছে। বন্দুকওয়ালারাও একই পয়েন্টে আটকে যাবে, তাদের সামনেও একই শাস্তির খড়গ। তাহলে এ খাঁচা ভাঙব মোরা কেমন করে?
৩.
পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য সংগ্রাম করে এসেছেন। ’৭১-এর ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধও ছিল একটি গণতান্ত্রিক সংবিধানের জন্য। কিন্তু ’৫৬ সালের সংবিধানের বেলায় যেমন মওলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগের ৬৭০টি সংশোধনীকে উপেক্ষা করে 'সার্বভৌম ইসলামী প্রজাতন্ত্র' ঘোষণা করা হয়, ’৭২ সালেও বিরোধীদের সব সংশোধনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। যে সংবিধানে সব ক্ষমতার মালিক প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রের যেখানে মূলনীতি অনুযায়ী পরিচালনার বাধ্যবাধকতা নেই, যেখানে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়, যেখানে সংখ্যালঘিষ্ঠরা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধি হন, যেখানে সংশোধনের সীমা অসীম, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু যেখানে বিধিসম্মত, যেখানে অপরাপর জাতির কোনো স্বীকৃতি নেই—সেই সংবিধান যখন পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা অপরিবর্তনীয় হয়ে যায়, তখন আসলে সেই সংবিধানের মৃত্যু ঘটে, তখন নতুন সংবিধানের সুপ্ত চাহিদা লাভার মতো বেরিয়ে আসতে চায়। পঞ্চদশ সংশোধনী গণতান্ত্রিক সংবিধানের আকাঙ্ক্ষার বারুদে কি আগুন ধরিয়ে দেবে?
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।