নারী দিবস
ঘরে-বাইরে পুরুষের মনোভাব পাল্টাতে হবে
‘Think Equal, Build Smart, Innovate for Change’
‘মাসের তিন/চার দিন মনে হয় কোমরের সাথে কয়েক মণ ওজনের পাথর বেঁধে কাজ করছি’—এই লাইনটি গল্প-উপন্যাসে মানায় কিন্তু আপনার কর্মস্থলে যেটা মূলত পুরুষের পৃথিবী, সেখানে এক মেয়ে আপনি, আপনি কি বলতে পারবেন এই বেদনার কথা? শারীরিক যন্ত্রণার কথা?
প্রতিদিন স্তনে দু-চারটা চাপ না খেয়ে পাবলিক বাসে উঠতে পারবেন না, অনেকেই শরীর কাভার্ড করে ফেলছেন, মাথায় হিজাব, লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। পুরুষসিংহরা যেভাবে পারছেন একটা করে গুঁতো বা চাপ মেয়েটাকে দিয়ে চলেছেন। এইসব পার হয়ে সঠিক সময়ে অফিসে ঢুকে "ফ্রেসলি" আপনাকে কাজ করতে হবে। যদি না পারেন, তবে আপনি চাকরিতে আনফিট।
অফিসে যৌন হয়রানি ঘটে। অনেক পুরুষই ভাবেন, এটা এমন কি! যৌন হয়রানির সংজ্ঞা কী, এটাও অনেক পুরুষ জানেন না। ঠাট্টাচ্ছলে একটু টিপে দেওয়া, কোনো মেয়ের ঘাড়ে বা পিঠে হাত দেওয়া, দু-একটা অশ্নীল জোকস বলা, এগুলো এমন কী ব্যাপার যার জন্য পুরুষ উত্তমকে হতে হবে বিচারের মুখোমুখি? আপনারা হ্যাশট্যাগ মি টু কেইস আনবেন? আপনাদের চাকরিই দেওয়া হবেনা। পারলে হ্যাশট্যাগ মি টু কে হাসিঠাট্টা ইয়ার্কির বিষয় বানিয়ে "উই টু উই টু" লিখে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হবে। লজ্জা সংকোচ নামে বস্তু এ সমাজের পুরুষদের থাকতে নেই।
এ তো গেল "বাহির"। ঘরে? আনপেইড ওয়ার্ক এই ধারণাটিকেই এখন পর্যন্ত স্টাব্লিশ করা যায়নি। কেন করা যাবে? বাবা-মা এখন পর্যন্ত কন্যার জন্য ভালো পাত্র খোঁজাকেই মনে করেন মোস্ট ইম্পরটেন্ট কাজ। "ভালো পাত্র" যাকে বলে তার সাথে নারী সমতার ধারণাটি কি ভয়ংকর সাংঘর্ষিক! "ভালো পাত্রস্থ" যখন কোনো নারী হন তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে হয়ে ওঠেন পুরুষের হাতের পুতুল। আনপেইড ওয়ার্ক আবার কি? সবই তো "নিজের সংসারের কাজ"।
এইসব বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এবারের নারী দিবসের ইউএন ঘোষিত থিম "থিংক ইক্যুয়াল, বিল্ড স্মার্ট, ইনোভেট ফর চেঞ্জ"। বলা হচ্ছে সারা বিশ্বে ৭৪০ মিলিয়ন নারী এখনো ইনফর্মাল অর্থনীতির সাথে যুক্ত, পুরুষের চেয়ে দুই দশমিক ছয় ভাগ বেশি নারী বিনা পারিশ্রমিকে গৃহশ্রম দেন, সারাবিশ্বে মাত্র ৪১ ভাগ নারী মাতৃত্বকালীন সুবিধা পান আর যতই ঘরের বাইরে যান বা ভেতরে থাকুক প্রতি ৩ জনের মধ্যে একজন নারী তার জীবদ্দশায় সহিংসতার শিকার হন। নারীর জন্য বান্ধব হয় না ঘর, কর্মস্থল বা নগর। কিন্তু তার দেয়া শ্রমটা বড় মিষ্টি।
নারী দিবসের স্লোগানটি সামনে রেখে, যুদ্ধে নারীর দম যেন না ফুরায় তার কিছু নিদান দেয়ার কথাই বললাম। এবারের দিবসের থিমে নারীর সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জনসেবায় নারীর প্রবেশাধিকার, নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে, আরো বলা হয়েছে লিঙ্গ সচেতন সমাজ গড়ার কথা, কিন্তু এমন সমাজ কারা গড়বেন সেটা একটা প্রশ্ন।
নারী হয়রানির ধরন শহরে গ্রামে বদলেছে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ ও রাষ্ট্রের কেমন, তা অধিকাংশ "শিক্ষিত" পুরুষের ফেসবুক আর অনলাইন কর্মকাণ্ডে বুঝতে পারা যায়। পুরো থিমে যেটা যুক্ত করা দরকার ছিল তা হলো নারীর সমতায় পুরুষের দায়িত্ব। পুরুষ নারীর সাথে যে আচরণ করে, কেন করে, কোন ভাবনা থেকে করে, সেইগুলো খুঁজে দেখার সময় হয়েছে।
নারীর সাথে ঘটা অন্যায় আচরণ এবং নির্যাতনের ধরন বুঝতে পুরুষের মনস্তত্ত্ব এবং পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকে বোঝার জন্য লড়াইটা জারি রাখতেই হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক