অগ্নিকাণ্ড

রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম স্থানান্তরই কি সমাধান?

Looks like you've blocked notifications!

প্রধানমন্ত্রী পুরান ঢাকা থেকে দ্রুততর সময়ে রাসায়নিক দ্রব্যের গুদাম সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। মেয়র সাঈদ খোকন বরাবরই বলে আসছেন, পুরান ঢাকায় কোনো ধরনের দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালের গোডাউন থাকতে দেওয়া হবে না এবং সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার দরুন গোডাউন উচ্ছেদে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরাতে অতিসত্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোনো এলাকায় যদি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ব্লাস্ট হয়ে আগুন ধরে, তাহলে কি ওই এলাকার সব ট্রান্সফরমার সরিয়ে ফেলা হবে? কিংবা কোথাও যদি গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে আগুন লাগে, তাহলে কি ওই এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে? অথবা, বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে আগুন লাগলে প্রতিকার হিসেবে সব ওয়্যারিং খুলে ফেলে কি আমাদের অন্ধকারে থাকতে হবে? অবশ্যই নয়। বরং এসব ক্ষেত্রে আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির কথা বলি, উন্নত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির কথা বলি, এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই বাস্তবতায় কেন আমরা দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের পরিবর্তে সেগুলো আন্তর্জাতিক মান মেনে সঠিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, গোডাউন মালিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বাধ্যতামূলক নিরাপত্তাজনিত সব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছি না।

২.

শুধু জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোই নয়, সাধারণ জনগণও প্রায় সবাই বলছেন, পুরান ঢাকা থেকে অবিলম্বে দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যাল সরিয়ে ফেলতে। কিন্তু কেউই বলছেন না কোথায় সরাবেন? সরিয়ে নিয়ে কি এগুলো ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা অথবা উত্তরায় রাখবেন? না, ওখানে রাখা যাবে না। তাহলে কি মিরপুর, বনশ্রী, তেজগাঁও অথবা মোহাম্মদপুরে রাখবেন? না, সেখানেও রাখা যাবে না। তাহলে ঢাকার ভেতরে কোথায় রাখবেন, যেখানে রাখলে ব্যবসায়ীদের সুবিধা হয় এবং আগুন ধরার আর কোনো প্রকার আশঙ্কা থাকবে না? ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির উন্নয়ন না করে কেবল স্থানান্তরের মাধ্যমে দুর্ঘটনা থেকে মুক্তিলাভের এমন নিরাপদ স্থান কি ঢাকার ভেতরে আদৌ কোথাও আছে?

৩.

মনে রাখা দরকার, এই গোডাউনগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি, নানাবিধ ব্যবসায়িক সুযোগ-সুবিধার কারণে এগুলো গড়ে উঠেছে, যার ওপর দেশের অনেক ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্ভর করে। এখানে কোনো প্রকার বিঘ্ন সৃষ্টি হলে কেমিক্যালের ওপর নির্ভরশীল পুরো সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর চাইলেও প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যবসায়িক সেক্টরকে সহসা অন্য স্থানে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া যায় না।

ছোট ছোট কেমিক্যাল গোডাউনের জন্য টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস মালিকদের নানা ধরনের কমপ্লায়েন্স অডিটের সম্মুখীন হতে হয়। গোডাউনের ব্যবস্থাপককে কেমিক্যাল ম্যানেজমেন্টের ওপর নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই কমপ্লায়েন্স না করে কেউ ভালো বায়ারের সঙ্গে কাজ করতে পারে না। প্রশ্নের উদ্রেক স্বাভাবিক, তাহলে পুরান ঢাকার এই বড় বড় গোডাউনকে কোনো প্রকার কমপ্লায়েন্স ছাড়াই ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে কেন? কেন এখানে কোনো ধরনের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নেই?

সুতরাং, দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে ফেলা কোনো সমাধান নয়, বরং অনুসন্ধান ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে কেমিক্যালকেন্দ্রিক দুর্ঘটনাগুলো মূল কারণ বের করে সেগুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। মূল কারণ দূর করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। আর সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে।

১. কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপনের জন্য কেমিক্যাল ম্যানেজমেন্টের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে নির্দেশিকা বই তৈরি করতে হবে, যা সিটি করপোরেশনের ‘কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপনার নির্দেশনাসমূহ’ বলে বিবেচিত হবে।

২. কেমিক্যাল কোম্পানির মালিকদের ‘কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপনার নির্দেশনাসমূহ’ মেনে চলার জন্য সচেতনতা তৈরি এবং তা মেনে চলার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে।

৩. নিরপেক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎ লোকবলের দ্বারা ‘কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপনার নির্দেশনাসমূহ’র ওপর কমপ্লায়েন্স অডিটের ফলাফলের ভিত্তিতে ট্রেড লাইসেন্স প্রদান করতে হবে।

৪. ‘কেমিক্যাল গোডাউন স্থাপনার নির্দেশনাসমূহ’ মেনে চলার ভিত্তিতে কেমিক্যাল গোডাউনগুলোকে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’— এই তিন শ্রেণিতে ভাগ করতে হবে।

৫. পুরান ঢাকাসহ ঢাকার সব বৈধ কেমিক্যাল কোম্পানির নাম, ঠিকানা ও শ্রেণি (‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে এবং কোম্পানির মালিকদের বৈধ কেমিক্যাল কোম্পানি থেকে কেমিক্যাল ক্রয়ে উৎসাহিত করতে হবে।

৬. যাঁরা কমপ্লায়েন্স মেনে চলতে ব্যর্থ হবেন, তাঁদের ব্যবসা অব্যাহত রাখার শর্ত হিসেবে তা পরিপূর্ণ করার জন্য সময় বেঁধে দিতে হবে।

৭. কমপ্লায়েন্সের ওপর সচেতনতা সৃষ্টি এবং সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সরকারিভাবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের পদক্ষেপ নিতে হবে।

অজস্র মানুষের কর্মসংস্থান, দেশের অর্থনীতির প্রাণ, হাজারো কোম্পানির অপরিহার্য উপাদান কেমিক্যাল বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানাদির ওপরে তাই অযৌক্তিক চাপ নয়, বরং যথাযথ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা সুরক্ষায় উপরোল্লিখিত পরামর্শসমূহে আমলে নিয়ে বাস্তবায়নে সচেষ্ট হলেই কেমিক্যালকেন্দ্রিক উদ্ভূত এ সমস্যা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।

লেখক : প্রোপ্রাইটর ও ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট, সেন্টার ফর কোয়ালিটি সলিউশন (সিকিউএস)