চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডি

আগুন ও আমাদের মানবিক বিপর্যয়

Looks like you've blocked notifications!

অসাধুতার দুর্মর অভিশাপ মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। দেশে রোজ অপঘাতে মারা পড়ছে মানুষ। মানুষের জন্য নিরাপদ নয় সড়ক, নিরাপদ নয় কর্মস্থলও। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো পরিবারে অকাল মৃত্যুর বিভীষিকা নিয়ে হাজির হয় অগ্নি বা সড়ক দুর্ঘটনা। মানুষ চাইলেই যা নিবারণ করা যেত। কিন্তু দায়িত্বশীলদের বেঘোর ঘুমে রোজ বাড়ছে আমজনতার হাহাকার। আহাজারির বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে শত পরিবার। 

এবার আগুনে ঝরে গেল চকবাজারের চুড়িহাট্টায় সত্তরেরও অধিক প্রাণ। রাজ্জাক ভবনের আগুন কয়েকশ পরিবারে অভিশাপ নামিয়ে দিয়েছে। প্রায় শত মায়ের বুক খালি হয়েছে, পিতা ও মাতাহারা হয়েছে অসহায় সন্তানেরা। হাসপাতালে দগ্ধতার যন্ত্রণায় কাটাচ্ছে কয়েক শ মানুষ। এত দুঃখভার সইবার সক্ষমতা সত্যি আমাদের নেই। বিবেকের বিচার তো আমরা পাই না, প্রকৃতির সমুচিত জবাব তবে ধার্য হোক রথীদের বিরুদ্ধে। মানুষের কান্নার কাতারের শামিল হোক ক্ষমতাবান সামন্তপ্রভুরা।

চুড়িহাট্টার পুড়ে যাওয়া রাজ্জাক ভবন যেন ২০১০ সালের ৩ জুনের নিমতলী। সেদিন প্রায় একইধারায় রাসায়নিকের আগুনে জ্বলে উঠেছিল নিমতলী। প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন নিরুপায় মানুষ। চকবাজারের ঘিঞ্জি এলাকার সেদিনের মানবিক বিপর্যয় যেন আবার নিয়ে এল ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্য রাতে। মানুষের ক্রন্দনের স্বরুপ বদলায় না। অনিঃশেষ দুঃখের জগদ্দল পাথরও তার চিরায়ত বেদনা জাগাতে ভুলে না। সরকারের কুম্ভকর্ণের ঘুম আর রাবণের ধ্বংসলীলা যেন সমানুপাতিক। তারা হাত ধরাধরি করে হেঁটে চলেছে বাংলাদেশের পথ। দায়বোধের অনুশোচনা সেখানে বাগরা দিতেই ভুলে গেছে।  

চকবাজার এলাকায় নকল পারফিউমে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের অবৈধ ভাগাড়। বাংলাদেশে ৭০ ভাগেরও অধিক ভবন বিল্ডিং কোড না মেনেই নির্মাণ করা গেছে। সেই বিল্ডিংগুলোতে নেই ন্যূনতম ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা। ভবনগুলো গুদাম বা কারখানা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অনুমোদন নেওয়ার কথা। আজকাল বিল্ডিংকোড মান্যতা নিয়ে খুব বেশি না ভাবলেও চলে। অনুমোদনের জায়গাগুলোর ব্রোকারদের কাছে চাহিদামাফিক কড়ি পৌঁছে দিলে যেখানে যেভাবে খুশি হাইরাইজ বিল্ডিং তুলে ফেলা যায়। এমন বাস্তবতায় আমাদের মৃত্যুদূতকে স্বয়ং আমরাই পেলেপুষে বড় করে রাখছি। যাতে নিমতলী, চুড়িহাট্টা, তাজরিন ফ্যাশন বা চট্টগ্রামের চাক্তাই বস্তিগুলোর অবোধ ও অবুঝ প্রাণেরা অকালে বারবার যমদূতের হাতে সহজেই সমর্পিত হতে পারে। দেশে কিন্তু অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড-২০১২ নামে সুগ্রন্থিত দুটি আইন বলবৎ আছে। কিন্তু সেসব আইন কিতাব থেকে কাজির গোশালায় আনতে পারে এমন কেউ কি কোথাও আছেন?

নিমতলীর ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে সরকার বা জনগণ কোনো পক্ষেরই শিক্ষা হয়নি। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনার পর তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি আর হয়নি। বাংলাদেশের নদী দুষণ ও দখলমুক্ত হয় না, পোশাক কারখানায় ফিরে না কর্মপরিবেশ, হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সাভারে স্থানান্তর হয় না। তাই আশা করছি রাসায়নিক গুদামসমূহও আরো দীর্ঘদিন চকবাজারের শোভাবর্ধন করবে, গন্ধ ছড়াবে এবং হুতাসন জ্বেলে জীবন্ত মানুষের চিতা রক্ষার ধারাবাহিকতাও বজায় রেখে যাবে। নগরে আগুন লাগুক, দেবালয় তো রক্ষা পেয়েই চলেছে। আমরা বরং সুখ-দুঃখের সব দায়ভার ঈশ্বরের কুদরতি হাতে সমপর্ণ করে নির্ভার থাকি। অপঘাতে অকাল মরণরে ডরিয়ে কী লাভ? ঈশ্বরের সন্তান মানবের সৃজন করা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানোর চিন্তা করা নিশ্চয় পাপ!

দেশে রোজই বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসও তাদের সাধ্যানুযায়ী আগুন নেভায়। কিন্তু রাস্তা না রেখে আমরা বিল্ডিং বানাতে পারি, পর্যাপ্ত ওয়াটার রিজার্ভ না রাখলেও চলে। অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থার পেছনে খামোখা টাকা ঢেলে কী লাভ? এই যখন আমাদের সাধারণের বোধ, বিবেচনা ও বুদ্ধি। তাহলে এই আমজনতার বিবেক না ফিরিয়ে আগুনের পেছনে ধাওয়া করে কী ফায়দা হতে পারে? বিশ্বের অত্যাধুনিক ও সবচে’ সক্ষম ফায়ার সার্ভিসও স্বার্থপর, লোভী ও ধান্ধাবাজ বাঙালির আগুন নেভাতে পারবে না। কারণ ফায়ার সার্ভিসের ইকুইপমেন্টই আগুনলাগা ভবনঅবধি পৌছাতে পারবে না। সেই ব্যবস্থা তো ভবন মালিকরা রাখেন না। আমাদের সব পক্ষের মৃতপ্রায় নীতিবোধ জাগানোটা জরুরি সবার আগে। কারো মন ও মগজে যদি বিবেক ফেরে তবে নিজের ঘরের আগুন সেই মানুষটি নিজেই প্রাথমিক পর্যায়েই সামাল দিতে পারবে। রাজদণ্ডের পাশে থাকা তখন হবে কেবলই ওপরি পাওনা।

মানুষের জীবন খুবই ক্ষুদ্র, কিন্তু তার সম্ভাবনা অসীম। সে সম্ভাবনা দিয়ে আমাদের ক্ষুদ্রতা ও নিচুতাকে যদি ঢেকে দিতে পারি তবে মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের বড়ত্বেরই প্রমাণ রাখতে পারি। আমাদের চাওয়া খুব ছোট। আমরা সবাই যেন মানুষ হয়ে উঠি। সাধুতার চর্চা করি। সত্য ও সুন্দরের আরাধ্য হই। তবেই কেবল মানুষের ক্রমাগত ক্রন্দনের রাশ টেনে ধরতে পারব। আমরা আর অসাধুতার আগুনে মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে চাই না। দুর্দমনীয় আগুনকে থামাতেই হবে।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন