অমর একুশে

শিক্ষা মাধ্যমে উপেক্ষিত প্রাণের বর্ণমালা!

Looks like you've blocked notifications!

ভাইয়ের রক্ত রাঙিয়ে এবং ছেলেহারা মায়ের অশ্রু ঝরায়ে যে ভাষাকে এই ভূমিতে তার ঠিকানা সুসংহত করতে হয়েছে, সেই ভাষার প্রতি মানুষের প্রেম ও ভরসা দুর্নিবার থাকার কথা ছিল। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণার পর আমাদের ভাষার মর্যাদা ও গৌরব শিখর স্পর্শ করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা বাঙালিরা নিজের সংস্কৃতি ও কৃষ্টি ধারণ করার চেয়ে আরোপিত ভাষার আগ্রাসনকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে শিখে গেছি। মায়ের শিখিয়ে দেওয়া বুলিকে নিঃসংকোচে জলাঞ্জলি দিয়ে চলেছি। বাংলাভাষার জন্য এ এক বিষাদময় ভিন্ন উপাখ্যান।

এখনো বাংলাদেশের দাপ্তরিক, আইনি ও শিক্ষার ভাষা বাংলা নয়। ভাষা শহীদ রফিক সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরদের রেখে যাওয়া প্রাণের বর্ণমালার প্রতি আমাদের উপেক্ষা নিশ্চিতই আমাদের বোধের অবনমন। খুব সহসাই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথও আমরা দেখি না।

আমাদের রাষ্ট্রীয় কিতাবে সর্বস্তরে বাংলা চালু করার কথাই বলা আছে। আমরা ভাষণ সেমিনারেও রোজ এমনটাই দাবি করি। কিন্তু এসবই যে স্রেফ কথার কথা তা কারো বোধের অগম্য নয়। অথচ আমাদের নিজস্ব মাতৃভাষা যদি শিক্ষার বাহন হতো তবে জ্ঞানের সমুদ্রে আমাদের সমন্বিত যাত্রাটা নিশ্চিতই আরো সুখকর ও মর্যাদাকর হতে পারত। বৈশ্বিক ভাষা হিসেবে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজির গুরুত্ব অস্বীকার করবার কোনোই উপাই নেই। গ্লোবাল ভিলেজে নিজেদের খাপ খাওয়াতে ইংরেজি চর্চার অনিবার্যতা স্বীকার করেও নিজের ভাষার প্রতি দরদটা সবার আগেই রাখা যেত। নিজের মায়ের ভাষার বুৎপত্তি অর্জন না করে অন্যের মাতৃভাষা আত্মস্থ করতে যাওয়া অতিশয় বোকামি। এখনকার বাস্তবতায় আমরা প্রাণপণ যেন সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।

যথেষ্ট গবেষণা ও প্রস্তুতি ছাড়া আমরা বিদ্যাপীঠে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার কথা বলতে চাই না। চিকিৎসা ও প্রকৌশলবিদ্যার তত্ত্ব ও তথ্যের যথোপযুক্ত অনুবাদ এবং পরিভাষা ঠিক না করে বাংলা ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হবে এক ধরনের জোরজবরদস্তির শামিল। বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলী আবিষ্কারে বাংলাভাষী বিজ্ঞানী বা গবেষকের সংখ্যা খুবই সীমিত। রোজই উন্নততর গবেষণাপত্র বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ হয়ে চলেছে। এখনো ব্রিটিশ আইনই আমাদের প্রায় একমাত্র ভরসা। ইংরেজি ভাষায় সেগুলোর বোধগম্যতা যতটা বাংলায় ঠিক তার বিপরীত। কিন্তু যদি আমরা কয়েক দশক আগে প্রযুক্তির যুগে প্রবেশের কালে জাপানি মাতৃভাষা প্রীতির ভাবধারাটা অনুসরণ করতে পারতাম নিঃসন্দেহে আমাদের জ্ঞানগরিমার স্বরূপটা ভিন্নতর হতে পারত।

বাংলা ভাষা নিয়ে সবচে’ বেশি চর্চা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রতিটি রচনাকর্মই বাংলা ভাষা অনুশীলনের একেকটি প্রামাণ্য দলিল। তিনি সবসময় সবল ও সতেজ বাংলা ভাষা চেয়েছিলেন। তাঁর সব লেখনি ও চিন্তাই ছিল মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ব্রিটিশ আমলের উচ্চশিক্ষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্পষ্ট উচ্চারণ এমন, ‘আমরা নিজের ভাষায় রসনা দিয়া খাই না; আমাদের কলে করিয়া খাওয়ানো হয়, তাতে আমাদের পেট ভর্তি করে, দেহপূর্তি করে না’। কবিগুরু বিশ্বাস করতেন শিক্ষায় মাতৃভাষাই হলো মাতৃদুগ্ধের পরিপুষ্টি। ‘শিক্ষা’ প্রবন্ধে তিনি যথার্থ বলেছেন, ‘একে তো ইংরেজি ভাষা অতিমাত্রায় বিজাতীয় ভাষা। শব্দ বিন্যাস, পদ বিন্যাস সম্বন্ধে আমাদের ভাষার সহিত তাহার কোনো প্রকার মিল নাই। তাহার পরে আবার ভাব বিন্যাস এবং বিষয় প্রসঙ্গও বিদেশি। আগাগোড়া কিছুই পরিচিত নহে, সুতরাং ধারণা করিবার পূর্বেই মুখস্ত করিতে হয়। তাহাতে না চিবাইয়া গিলিয়া খাইবার ফল হয়।’ মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজের রচনায় আয়ারল্যান্ডের প্রসঙ্গ টেনেছেন। ইউরোপের অন্ধকার যুগেও আয়ারল্যান্ড কিঞ্চিৎ আলো জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছিল, তার অন্যতম কারণ মাতৃভাষায় শিক্ষা। সেখানে শিক্ষার্থীরা ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু শিখত ঠিকই, কিন্তু এসব শেখানোর ভাষা ছিল আইরিশ। একসময় আইরিশের বদলে শিক্ষার বাহন করা হলো ইংরেজি। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু লিখেছেন, ‘ইহার ফল যেমন হওয়া উচিত, তাহাই হইল। মানসিক জড়তা সমস্ত দেশে ব্যাপ্ত হইয়া গেল। আইরিশভাষী ছেলেরা বুদ্ধি এবং জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল, আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া। ইহার কারণ এ শিক্ষা প্রণালী কলের প্রণালী, ইহাতে মন খাটে না, ছেলেরা তোতা পাখি বনিয়া যায়।’

রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাটা যেমন ভালো জানতেন, তাঁর ইংরেজি দক্ষতাটাও ছিল সমানুপাতিক। এ কারণেই তাঁর নোবেলজয়ী অমরকাব্য ‘গীতাঞ্জলি’কে ‘সং অফারিংস’-এ রুপান্তর করতে পেরেছিলেন। যা পাঠে ইংরেজ কবিরাও যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু আমাদের কালে আমরা উন্নাসিক বাঙালিরা নিজের মায়ের বুলিকে চরম অবহেলায় পায়ে দলে ইংরেজি শেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছি। দু’ চার লাইন ইংরেজি বলতে পারলেই উৎরে গেছি বলে ভাবতে শিখেছি। আমাদের এমন সীমিত জ্ঞান লাভে নিজের সংস্কৃতি ও শেকড়ের কোনো পরিপুষ্টি তো হয়ই না। বরং আমরা নিজেদের স্বাজাত্য বোধ ভুলে এক ধরনের আত্মপরিচয় ভোলা ঊণমানুষে রুপান্তর হয়ে চলেছি। 

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান লেখকও একসময় ইংরেজি ভাষাকে নিজেদের ভাব প্রকাশের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু মাতৃভাষায় ফিরে আসার বোধোদয়ে তাদের খুব বেশি দেরি হয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতত্ত্ববিদ মুনীর চৌধুরী মাতৃভাষার স্বরূপ আঁকতে গিয়ে বলেছেন, আমার মাতৃভাষা কী? বাংলা ভাষা। সমগ্র বাংলা ভাষা। বিচিত্ররূপিনী বাংলা ভাষা। অভিধানে আছে ষোড়শ রমণী মাতৃসম্বোধনীযোগ্য। শ্বশ্রূ থেকে তনয়া, গর্ভধারিণী সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী, আরাকানের রাজসভার মণিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা।

আমাদের এমন মহত্তম মাতৃভাষাকে আমরা শিক্ষার বাহন করতে পারিনি বলেই আমাদের রোজকার দাপ্তরিক ও আইনি ভাষা এখনো বাংলা নয়। আমাদের প্রাণের ভাষার এর চেয়ে বড় অমর্যাদা হয়তো আর কিছুই নেই। দেশের ইংরেজি মিডিয়াম বিদ্যায়তনে শেখানো হয় মুখস্ত ইংরেজি, ধর্মশালায় শেখানো হয় ঐশী ভাষা। সংখ্যাগুরুর প্রার্থনালয়ে সংস্কৃতসঞ্জাত বাংলা বলা মানে গুনাহের কাজ। বড় করপোরেট হাউজ কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের দাপ্তরিক ভাষাও কপিপেস্ট ঔপনিবেশিক ইংরেজি। স্বভাবতই আমজনতার ভাষাও এখন ভুলভাল বাংলা, ইংরেজি ও ধর্মভাষার ব্যাঙ্গাত্মক গুরুচণ্ডালি। এইভাবে প্রায় সবখানেই বিপ্লব, বিদ্রোহ আর প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া অমৃত বাংলাভাষার অধঃপাত ঘটিয়ে চলেছি আমরা।

ভাষার প্রতি এমন বেদনাকর উপেক্ষা, অবহেলা ও অনাদর ঘোচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার। একুশের একটি দিন ভাষা শহীদদের স্মরণের মাধ্যমে ভাষার মর্যাদা ফেরানো যাবে না। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আদর্শ বাংলা ভাষা আত্মীকরণ আমাদের জোরালো দাবি। এই দাবি মান্যতার মধ্যেই কেবল একুশের আবেগ ও কর্তব্য নিহিত থাকতে পারে। সর্বস্তরের শিক্ষা মাধ্যমে উপেক্ষিত না থাকুক আমাদের প্রাণের বর্ণমালা। দুঃখ ও শ্রান্তিনাশা মায়ের ভাষার জয় হোক সর্বত্র। কবি অতুলপ্রসাদ সেন আমাদের মননে জাগরুক থাকুক :

মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা

তোমার কোলে তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা।

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন