১৪ ফেব্রুয়ারি

স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস কি বিস্মৃত?

Looks like you've blocked notifications!

সুবিধাবাদিতাকে সুযোগ করে দিতে জ্বলজ্যান্ত ইতিহাসকে মেরে ফেলবার চেষ্টা হয়তো করা যায়, কিন্তু ইতিহাস কখনোই মরে না। ইতিহাস সূর্যের আলোর মতো। সাময়িকভাবে তার কিরণকে মেঘের আড়াল করা যায় বটে, শেষ পর্যন্ত জয় ওই দিবাকরেরই। আজকের তারুণ্যকে জানতে হবে প্রিয়জনে ফুল ছড়িয়ে দেওয়া ভালোবাসার দিনটির আরেকটি অন্যরকম মহিমা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে কারুণ্য-জাগানিয়া ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ বলে একটি দিন বিদ্যমান রয়েছে।

মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক যে, আন্তর্জাতিক ভালোবাসা দিবসের বাতাবরণে আজকের এই দিনটিকে ঢেকে দেওয়া গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’। বিস্মরণের অতলে হারালেই কি ইতিহাসের ধ্রুব সত্যকে নিশ্চিহ্ন করা যায়? বাংলাদেশের সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক বিস্ময়-জাগানিয়া চরিত্র। পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসকই তাদের দেশ ও মানবতাবিরোধী অতীত অপকর্মের জন্য বিনা বিচারে পার পেয়ে যায়নি, একমাত্র এরশাদ ছাড়া। যার শাসনকালটার কৃষ্ণকায় উঠোনজুড়ে প্রতিবাদী মানুষের রক্তের রঞ্জন ছিল রোজকার ঘটনা। সেই এরশাদ তিন যুগ পরেও সংসদের বিরোধীদলীয় শোভাবর্ধক বাতিঘর। তার অনেকখানি আলোতেই চমকিত হচ্ছে আমাদের হালের গণতন্ত্র।

এরশাদের নয় বছরের শাসনকাল বহু উপাখ্যানে ভরা। ১৯৮২ সালে তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান বৈষম্যপূর্ণ পুরোনো ধ্যানধারণাপুষ্ট শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। এই নীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে বলে ছাত্ররা এর প্রবল বিরোধিতা করে। কার্যত এর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন শুরু করে।

ওই বছর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের বিষয়ে একমত হয় ছাত্রসংগঠগুলো। এর ধারাবাহিকতায় পরের বছর ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। এ উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মজিদ খানের ওই কুখ্যাত শিক্ষানীতি প্রত্যাহার, বন্দি মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া এবং গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকা ওই সমাবেশে পুলিশ গুলি করলে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, দীপালি সাহাসহ অনেকেই। পরে সারা দেশেই এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রামসহ দেশের অপরাপর স্থানেও হতাহতের ঘটনা ঘটায়।

এরশাদের বশংবদ পুলিশ। সেদিন থেকেই ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে বলা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সারা দেশেই ঘটেছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনা। প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী এমনকি সাধারণ মানুষকেও জেলে পুরে নির্যাতন করতে থাকে এরশাদের সাজানো সরকার। এমন আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেনকে হত্যা করে এরশাদের পুলিশ বাহিনী। এবং ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর এরশাদের সন্ত্রাসী বাহিনী গুলি করে হত্যা করে ডা. মিলনকে। এতেও শেষ রক্ষা হয় না এরশাদের।

অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন হয় দখলবাজ স্বৈরাচার এরশাদের। কিন্তু সেই এরশাদ দেশের রাজনীতিবিদ ও গণমাধ্যমের আপসকামিতার সুযোগে কেমন দারুণভাবে বাংলাদেশের সমাজ-সংসারে টিকে রয়েছেন। রাজনীতির ঘোড়ার চাল তাঁকে ছাড়া আর কল্পনাই করা যায় না। তিনি তাই সগর্বে বলে যেতে পারেন, ‘আমাকে স্বৈরাচার বলবেন না, আমি ছিলাম শ্রেষ্ঠ শাসক।’ তো, এহেন মহত্তম শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দিবস পালন কি মনভোলা বাঙালির শোভা পায়?

’৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারির পর ’৮৩-এর ১৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র-শিক্ষকের তাৎপর্ময় বিশাল আন্দোলনকে বিস্মৃতির গহ্বরে পতিত করা গেছে। এখন আর এসব নিয়ে কেউ আলোচনাও করে না, মাথাও ঘামায় না! কিন্তু শহীদ নূর হোসেন, ডা. মিলন, জাফর, জয়নাল, দীপালিসহ হাজারো নাম না জানা আত্মার ক্রন্দন কি থামানো যাবে? তাঁদের অভিশাপ থেকে আমাদের বোধ ও বিবেককে কি রক্ষা করা যাবে? এইসব শহীদের স্বজনরাই বা কেমন অনুভব করেন, যখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ সেই এরশাদ এখনো ক্ষমতার আচ্ছাদনে থেকে পরম প্রশান্তিতে মহাপ্রয়াণের স্বপন দেখে যেতে পারেন!

ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কোনো আড়ি নেই। চাপিয়ে দেওয়া করপোরেট ধামাকায় পড়ে দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া বিপ্লবী বীরদের ভুলে যাওয়ার যে রোগে আমাদের পেয়ে বসেছে সে অসুস্থ চেতনার সঙ্গে যেকোনো স্বাধীনচেতা মুক্তচিন্তার মানুষেরই তর্ক থাকা উচিত। ছাত্র আন্দোলন আমাদের গৌরবময় বায়ান্ন দিয়েছে, মহান একাত্তর দিয়েছে, নব্বইয়ের স্বৈরাচার পতন দেখিয়েছে। সেই অবিনাশী বিদ্রোহী প্রাণকে ভুলে থাকবার মানসিকতা যেন আমাদের পেয়ে না বসে। আমাদের বলে যেতে হবে এরশাদের স্বশাসন হিংসায় মোড়ানো ছিল। ওই সময় এরশাদ নামক শাসকের চালচরিত্রও মোটেই ভালো ছিল না। তা না হলে অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বলে পৃথিবীতে আর কিছুই থাকবে না।

আমরা চাই রাজনীতিবিদদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চাটা বাড়ুক। মহত্তম চরিত্রের আরাধনা করুক সবাই। ছাত্রসংগঠনগুলো দলীয় লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে এবং যেনতেন পথে অর্থ উপার্জনের অসাধুতা পরিহার করে তাদের আগের শক্তিমত্তা ফিরে পাক। অতীত ইতিহাসের নিগূঢ় অনুসন্ধান করে অনুপ্রাণিত ছাত্রশক্তি প্রতিবাদের ভাষা রপ্ত করতে শিখুক। মানুষ অধিকার ও গণতন্ত্র সচেতন হোক। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস স্বস্থানে থাকুক। কিন্তু অতি ভালোবাসায় ঢেকে না যাক স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস।

 

লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।