দৃষ্টিপাত
ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহের তাৎপর্য
১০ ডিসেম্বর, জাতীয় ভ্যাট দিবস। অন্যদিকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে ‘ভ্যাট সপ্তাহ’। মূল্য সংযোজন করকে (মূসক বা ভ্যাট) অধিক জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর উদযাপিত হয় ‘জাতীয় ভ্যাট বা মূসক দিবস’ এবং ‘ভ্যাট সপ্তাহ’। ভ্যাটদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণ ও কর্মকর্তাদের সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে সারাদেশে ‘ভ্যাট’ উৎসব একযোগে পালিত হয়। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন-২০১২’ সংসদে পাস হয়। রাষ্ট্রপতি ১০ ডিসেম্বর এ আইনে স্বাক্ষর করেন। সে জন্য ১০ ডিসেম্বরকে সম্মান জানিয়ে ‘জাতীয় ভ্যাট দিবস’ পালন করা হয়।
ভ্যাট দিবসের স্লোগান হলো ‘ভ্যাট দিচ্ছে জনগণ, দেশের হচ্ছে উন্নয়ন’। ‘ভ্যাট সপ্তাহ’ এই স্লোগানকে লালন করছে ভবিষ্যৎপ্রসারী উন্নয়নের টার্গেট অর্জনের জন্য। উল্লেখ্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অষ্টমবারের মতো ‘ভ্যাট দিবস’ ও ‘ভ্যাট সপ্তাহ’ পালন করছে। আর ১০ ডিসেম্বর তৃতীয়বারের মতো দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। কারণ, এর আগে প্রতিবছর ১০ জুলাই জাতীয় ভ্যাট দিবস পালিত হতো। বাংলাদেশে ১৯৯১ সালে ‘ভ্যাট’ প্রবর্তিত হওয়ার পর এ বিষয়ে অধিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ২০১১ সাল থেকে দিবস ও সপ্তাহ উদযাপন করা হচ্ছে। ১৯৯১ সালে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তনের পর থেকে ভ্যাট ছিল রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে ভ্যাট আদায় করা হয় এক হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা। এর পর থেকে রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ভ্যাটকে বেছে নেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিনের এ ধারাবাহিকতা ভাঙতে একাধিকবার প্রত্যক্ষ কর বা আয়করকে রাজস্ব আয়ের প্রধান খাত হিসেবে পরিণত করার ইচ্ছা পোষণ করলেও ভ্যাটের বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি অর্থ মন্ত্রণালয়।
ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বাংলায় সংক্ষেপে বলা হয় ‘মূসক’। এই ভ্যাট দেশের ধনী-গরিব সব নাগরিককেই দিতে হয়। ‘ভ্যাট’ বলতে সেই মূল্যকে বোঝায়, যা উৎপাদক তার কাঁচামাল বা ক্রীত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে বিক্রয় করার আগে যুক্ত করে। মূসক আরোপের মাধ্যমে আবগারি শুল্ক ও বিক্রয় করের জটিলতা দূর হয়েছে। দেশের রাজস্ব বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ, শিল্প ও কলকারখানার সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কর ফাঁকি রোধ, ব্যয় হ্রাস, বৈষম্য হ্রাস এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ভ্যাট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এই ভ্যাট প্রথা বিশ্বে সর্বপ্রথম চালু হয় ১৯২২ সালে জার্মানিতে। এর পর ১৯৫৩ সালে আর্জেন্টিনায়, ১৯৪০ সালে জাপানে এবং ১৯৪৮ সালে ফ্রান্সে চালু করা হয়। উন্নত দেশগুলোর মধ্যে ইংল্যান্ড, কানাডায়ও ভ্যাট ব্যবস্থা চালু রয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে চীন, ভারত, পাকিস্তানে সীমিত আকারে এবং ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে, আইভরি কোস্ট, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপক আকারে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
গত চার অর্থবছরে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক থেকে রাজস্ব আদায় বাড়ানো হয়েছে। আর গত পাঁচ বছরে যত রাজস্ব আহরিত হয়েছে, তার প্রায় ৩৬ শতাংশ এসেছে ভ্যাট থেকে। আমাদের দেশে রাজস্ব আয় প্রতিবছরই বাড়ছে। আবার বাজেটের আকারও বছর বছর বাড়ছে। বর্তমানে জিডিপিতে ভ্যাটের অবদান ১১ শতাংশ। আগামী ২০২১ সালের মধ্যে ভ্যাটের এ অবদান বাড়িয়ে ২০ শতাংশ নেওয়ার চিন্তা রয়েছে। কারণ, আগামী ২০২১ সালের মধ্যে এ দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের মাধ্যমে আদায়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এক লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের এ খাতের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৭ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক আহরিত রাজস্বের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও সম্পূরক শুল্ক থেকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় হয়। ‘অর্থ আইন ২০১৮’-এ ৪৩০টিরও বেশি পণ্য বা পণ্যসামগ্রীর ওপর সম্পূরক শুল্ক আরোপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসবের মধ্যে কিছু পণ্যের সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। আবার কিছু পণ্যের সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি বা হ্রাস করার কথা বলা হয়েছে। পণ্যের প্রকারভেদে সর্বনিম্ন ১০ এবং সর্বোচ্চ ৫০০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পূরক শুল্ক ধার্য রয়েছে। ভ্যাট খাতে এ বিশাল টার্গেট আদায়ে বাজেটে বিলাসবহুল পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি, ভ্যাট ফাঁকি রোধে ইলেকট্রনিকস ফিসক্যাল ডিভাইসের (ইএফডি) প্রচলন ও আরো নতুন নতুন খাতকে ভ্যাটের আওতায় আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে ভ্যাট সিস্টেমকে অনলাইননির্ভর করে তোলা হয়েছে।
নতুন ভ্যাট ও মূসক আইনের বাস্তবায়ন দ্রুত করা জরুরি। সরকার বিগত বাজেটে ভ্যাট ও মূসক আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিল। ব্যবসায়ীদের অনুরোধে, রাজনৈতিক কারণে সরকার ভ্যাট ও মূসক আইন বাস্তবায়ন দুবছরের জন্য স্থগিত করে। কিন্তু ভ্যাট বৃদ্ধি ও ভ্যাটের নতুন নতুন খাত বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে দেশের রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে পুরো রাজস্ব প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়েছে। সমগ্র কর ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির আওতায় আনা হয়েছে। এতে রাজস্ব প্রদান ও রাজস্ব আহরণ উভয় কার্যক্রমই সহজ ও সরল হয়েছে এবং ক্রমান্বয়ে রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময় ও অর্থের সাশ্রয় করে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ‘মূল্য সংযোজন কর’ (ভ্যাট) ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে নতুন ‘মূল্য সংযোজন কর আইন, ২০১২’ বাস্তবায়ন হচ্ছে। আত্মমর্যাদায় বলীয়ান স্বনির্ভর জাতির চাবিকাঠি হচ্ছে সমৃদ্ধ রাজস্ব ভাণ্ডার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের মাধ্যমে জাতির এ লক্ষ্য অর্জনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, ভ্যাট ফাঁকি রোধে সততা, নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া রাজস্ব কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করা, অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনা, মূসক দলিলাদি প্রেরণ নিশ্চিতকরণ, দাখিলপত্রে প্রদর্শিত সব ধরনের ক্রয় (আমদানি ও স্থানীয় পর্যায়ে) এবং বিক্রয়ের সঙ্গে ওই প্রতিষ্ঠানের ক্রয়-বিক্রয় ক্রস চেকিং করা আবশ্যক এবং পণ্যের প্রদর্শিত মূল্য ও প্রকৃত মূল্য যাচাই করাও একটি প্রধান কাজ। যথাযথভাবে এসব দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় ভ্যাট দিবস’ উদযাপন ও ‘ভ্যাট সপ্তাহ’ পালন আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা