অভিমত
রাজনীতিতে নীতির বিসর্জন
সম্প্রতি জোট গঠন ও মনোনয়নের দরকষাকষিতে রাজনীতিতে আদর্শ ও অনাদর্শের প্রশ্নটি খুব বেশি সামনে এসেছে। বেশ কিছু রাজনীতিবিদের দলত্যাগের ধরন দেখে মনে হয়েছে, রাজনীতিতে আদর্শ বলতে কিছু নেই। রাজনীতিতে চাওয়া-পাওয়ার প্রশ্নটিই এখন মুখ্য, সেটি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রমাণ হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে দল বা জোট বদলের যেসব অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে, এমনটি আগে কখনো দেখা যায়নি। কতিপয় রাজনৈতিক নেতা যেন লজ্জা-শরমের মাথা খেয়েই দলবদল করছেন। কেউ কেউ আজীবন যে নীতি-আদর্শের অনুসারী ছিলেন এবং যে আদশের্র বাণী প্রচার করতেন, তিনি এবার গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন সে আদর্শের একেবারে বিপরীত মেরুতে। এ কথা সত্য যে, দলত্যাগের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। তবে সেসব ঘটনার পেছনে বেশ কিছু যুক্তি কিংবা ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়া যেত। কিন্তু এবার জোট বদল কিংবা দলবদলের ঘটনাগুলো আগের সব নিকৃষ্টতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক দলত্যাগের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণভাবেই ব্যক্তিস্বার্থ এবং ক্ষমতা-স্বার্থসংশ্লিষ্ট। একদল থেকে মনোনয়ন না পেয়েই দলত্যাগ করে বিপরীতমুখী দলে গিয়ে মনোনয়ন নিশ্চিত করার প্রবণতা নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতির সৃষ্টি করে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিবিদদের দলত্যাগ একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। ব্যক্তিস্বাধীনতা, চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হিসেবেই দলত্যাগকে বিবেচনা করা হয়। উন্নত গণতান্ত্রিক কৃষ্টির দেশেও দলত্যাগের ঘটনা ঘটে থাকে। তবে উন্নত দেশে দলত্যাগের প্রসঙ্গটি সাধারণত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থেই হয়ে থাকে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সেখানে রাজনীতিবিদরা দলত্যাগ কিংবা প্রয়োজনবোধে পদত্যাগও করেন। কিন্তু বাংলাদেশে ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত। মূলত তুচ্ছ এবং ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতিবিদরা দলত্যাগ করেন। উন্নত অনেক গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতিবিদরা জাতীয় স্বার্থে দলবদল করে নজির তৈরি করেন। এমনকি সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও জাতীয় স্বার্থে দলবদলের ইতিবাচক প্রবণতা উন্নত দেশগুলোতে লক্ষ করা যায়। শুধু তাই নয়, ওই সব দেশে দায়িত্বে অবহেলার প্রশ্ন ওঠার আগেই নির্দ্বিধায় সরকারি পদ থেকে পদত্যাগ করার নজির রয়েছে অহরহ, কিন্তু বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিপরীত। কোনো রাজনীতিবিদকে জাতীয় স্বার্থে দেশের সিংহভাগ জনসাধারণ পদত্যাগ করার দাবি জানালেও তাকে পদত্যাগ করানো যায় না।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক দলত্যাগের ঘটনা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। দেশের সচেতন ও সাধারণ নাগরিক সমাজের অনেকেই দলত্যাগের এই অবস্থাকে ‘বেশ্যাবৃত্তি’র সঙ্গে তুলনা করতে দ্বিধা করছে না। এর আগে আমরা মাঝেমধ্যেই নানা কারণে নেতাদের দলবদল করতে দেখেছি। বেশিরভাগ সময়েই দলবদলে আত্মস্বার্থ প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করতে দেখা গেছে। অবশ্য কোনো কোনো সময় আদর্শের প্রশ্নে অটল থেকেও দলত্যাগের ঘটনা দেখা গেছে। তবে সে সংখ্যা হাতে গোনা যায়।
যেসব নেতা একসময় বঙ্গবন্ধুকে আদর্শ মনে করতেন, তাঁদের অনেকেই আজ জিয়াউর রহমানকে তাঁর আদর্শিক নেতা হিসেবে মাথায় তুলেছেন। যাঁরা একসময় জিয়াউর রহমানকে নিন্দা করতেন, তাঁরা এখন জিয়াউর রহমানকে প্রশংসা করছেন কিংবা করবেন। আবার যাঁরা একসময় বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকার করতে দ্বিধা করতেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো আজ বঙ্গবন্ধু বলতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, একমাত্র তাঁকে ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাইকেই কেনা যায়। কথাটির গুরুত্ব বলে বোঝানোর দরকার নেই। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এর প্রমাণ দেশবাসী পেয়েছে। সে সময় সংস্কারের জার্সি গায়ে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছিলেন বড় দুই দলের মহাসচিব, প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ ছোট-বড় নানা ধরনের নেতা। সুতরাং যেকোনো নেতাই যেকোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ কিংবা ক্ষমতার লোভে বিক্রি হয়ে যেতে পারেন, তা অবিশ্বাস্য নয়। বরং তার প্রমাণ আমরা সাম্প্রতিক রাজনীতিতে দেখতে পাচ্ছি। সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রিত্ব পাওয়ার লোভে দলবদলের ঘটনাও ঘটেছে বাংলাদেশে। সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলত্যাগ করলে সংসদ সদস্যপদ চলে যাবে এমন বিধান থাকা সত্ত্বেও দলত্যাগের ঘটনা ঘটেছে।
একটি আসন পাওয়ার যোগ্যতা কিংবা সামর্থ্য নেই অথচ পরগাছার মতো ছোট দলগুলো নীতি-আদর্শের মিল না থাকলেও জোটে যাচ্ছে সুবিধা পাওয়ার আশায়। ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার লোভে। এমপি-মন্ত্রী হতে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে বিএনপি ছেড়ে এলডিপি গঠন করেন কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। ওই বছরই যোগ দেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। এক বছরের মাথায় মহাজোট ছাড়ে দলটি। ২০১২ সালে যোগ দেয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলে। এই হলো জোটে আসা ছোট দলগুলোর চরিত্র। এ ক্ষেত্রে এসব ছোট দল থেকে বৃহৎ দলগুলোর সাবধানে থাকাই তাদের দীর্ঘস্থায়ী রাজনীতির জন্য মঙ্গলজনক।
আমাদের রাজনীতিবিদরা একটি কথা প্রায় বলে থাকেন, ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।’ কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ নানা কারণে এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি তা আরো স্পষ্ট করেছে। জনগণকে ব্যবহার করা হয় অনেক রাজনীতিকের ক্ষমতা লাভের স্বার্থে। কিন্তু জনগণ মূল্যায়িত হয় না। এই দলবদলের রাজনীতি, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি ও নির্বাচন যত দিন ক্রিয়াশীল থাকবে, তত দিন সমষ্টিগত মানুষের বঞ্চনার অবসান ঘটবে না।
কাজেই ক্ষমতায় যেতে কিংবা ক্ষমতায় থাকতে এমন কোনো রাজনীতি কোনোভাবেই সমীচীন নয়। এ ক্ষেত্রে ভোটের ঝুড়িতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা থাকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়কেই একটা নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ বজায় রেখে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার যথেষ্ট ন্যায্যতা রয়েছে। বৃহৎ দল হিসেবে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পরগাছাদের খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সার্থকতা নেই। এমনকি ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় টিকে থাকার সমীকরণে পরগাছা দলগুলোর খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।