নির্বাচন
স্টারডমের শখের রাজনীতি ও ক্ষমতাবিলাস
গণমাধ্যমের প্রধান দুই খবর, মাশরাফি বিন মুর্তজা মনোনয়নপত্র কিনেছেন, এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দোয়া নিয়েছেন এবং সাকিব আল হাসানকে খেলায় মনোনিবেশ করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময়ের বাংলাদেশের রাজনীতি শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম তরুণদের জন্য বরণডালা সাজায় না। প্রজ্ঞাবান প্রবীণ রাজনীতিবিদদেরই চারণভূমি এটা। বড় রাজনৈতিক দলের প্রধানদের বয়স বিবেচনা করলেই এই ধারণা পাওয়া যায়। এমন বাস্তবতায় মাশরাফি বিন মুর্তজা, ফেরদৌস, শাকিব খান বা সাকিব আল হাসানরা যদি রাজনীতিতে আসতে চান, তাঁদের স্বাগত না জানিয়ে উপায় থাকে না। কিন্তু সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বস্বীকৃত অলরাউন্ডার ও বাংলা ক্রিকেটের তরুণ তুর্কি, যাঁর ওপর নির্ভর করে আছে আগামীর বিশ্বকাপ, তিনি যদি দলবাজিতে নাম লেখান, ক্রিকেট খেলবেন কখন? প্রধানমন্ত্রী বিবেচক, তাঁর নির্দেশনায় এ যাত্রা রণে ভঙ্গ দিয়েছেন সাকিব। প্রাইম মিনিস্টার তাঁকে খেলায় মনোনিবেশ করতে বলেছেন। ক্রিকেট ফ্যানদের জন্য আপাতত এটা স্বস্তির।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক, যিনি এখন পর্যন্ত ওয়ানডে দলের অধিনায়ক এবং ভালো ফর্মে আছেন, সেই মাশরাফি বিন মুর্তজা ক্ষমতাসীন দলের টিকেটে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়েছেন। আগামী এক মাস যিনি নিজের মনোনীত এলাকায় নৌকার পক্ষে মিছিল-মিটিংয়ে গলা ফাটাবেন এবং জনগণ চাইলে সংসদেও চলে যাবেন। কারণ, বাংলাদেশের কোনো এলাকায় মাশরাফির চেয়ে বেশি জনপ্রিয় মানুষ পাওয়া ভার। পত্রিকাওয়ালারাও খবর দিচ্ছে, মাশরাফির কাছে আর সবাই ম্লান! অবশ্য নড়াইলের বিএনপি জোটের নেতারা এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, মাশরাফি এলাকার সবচেয়ে ভালো ছেলে। কিন্তু ভোটের মাঠে তাঁকে আমরা ক্রিকেটার মাশরাফি হিসেবে বিবেচনা করব না। তিনি নৌকা মার্কার প্রার্থী ছাড়া আর বেশি কিছু না। জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন অধিনায়ক যখন থেকে পার্টিজান হয়ে গেলেন, তিনি হয়ে গেলেন খণ্ডিত একজন মানুষ। যাঁরা একসময় হারিজিতি মাশরাফির পক্ষে সর্বসম্মত বাজি ধরত, তাঁরা এখন ভাগ হয়ে যাচ্ছেন। মাশরাফির একটা নির্দিষ্ট মার্কা আছে। তার মানে এখন আর তিনি সর্বজনীন নন। তিনি স্রেফ দলীয় একজন। তিনি দল করবেন, এটা তাঁর সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু খেলাটাকে কীভাবে ধারণ করবেন? তিনি তো অবসর নেননি। বেশি বয়সে অ্যাথলেট হওয়া যায় না। সে ক্ষেত্রে একজন ক্রিকেটার যদি তাঁর যথার্থ সময়ে অবসর নেন, তিনি তরুণই থাকেন। কাজেই মাশরাফি অবসর গ্রহণ করার পরও দিব্যি রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করতে পারতেন।
ভারতের ক্রিকেটার আজহারউদ্দিন, শচীন টেন্ডুলকার, নবজ্যোত সিং সিধু, মোহাম্মদ কাইফ, ফুটবলার বাইচুং ভাটিয়া খেলা থেকে অবসরের পর রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে দেশের সাংসদ বা মন্ত্রী হয়েছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইমরান খান ওই দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু খেলাধুলার ফর্ম আর রাজনীতি হাত ধরাধরি করে চলে কি না, বিশ্বের অপরাপর দেশে জাতীয় দলের অধিনায়ক ক্ষমতার রাজনীতিতে নাম লেখান কি না, তেমন ইতিহাস আমাদের জানা নেই। মাশরাফি কি ইতিহাস রচনা করতে যাচ্ছেন? আমরা কি ভবিষ্যৎ এভাবে দেখব যে, একজন তুখোড় সাংসদ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে একটি জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব করছেন এবং পারফরম্যান্সের ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন! স্নায়ুক্ষয়ী রাজনীতিতে মনোনিবেশ করার পর ক্রিকেটীয় মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারবেন তো মাশরাফি? নাকি অবশেষে অকাল অবসর চেয়ে বসবেন?
অন্যদিকে, চিত্রনায়ক ফেরদৌস ও শাকিব খানও ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় যাচ্ছেন। নায়িকা শাবানাও আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছেন রাজনীতির সুঘ্রাণ নিতে। আমাদের জানা নেই শাসক দল ও এইসব স্বনামখ্যাত স্টার কে কার অলংকার? আওয়ামী লীগ এদেরকে সামনে রেখে পলিটিক্যাল স্টান্ট হাজির করছে, নাকি এঁরাই সক্ষমতার সতীর্থ হয়ে নিজেদের মুকুটে আরো পালক সংযোজন করার প্রয়াস পাচ্ছেন? নামী ক্রিকেটার বা দামি তারকা কাউকেই এখন পর্যন্ত বিরোধী জোটে নাম লেখাতে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে এইসব নামজাদা স্টারডমের মাধ্যমে বহুদর্শী রাজনীতির চাষ কীভাবে হবে, আমরা জানি না!
ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে দেশ ও মানবসেবা দোষের কিছু না। বরং তা নিশ্চিতার্থেই প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু একজন মাশরাফি বা শাকিব খান যদি জনসেবা করতে চান, তাঁদের কি দলদাস না হলে চলবে না? তাঁরা নিজেরাই তো একেকজন স্বতন্ত্র পার্টি। দলের বাইরে থেকেই তো বরং চ্যারিটি করা সহজ ও স্বস্তিকর। দল-মত নির্বিশেষে তাঁদের সবাই ভালোবাসে। দলীয় লেজুড়বৃত্তিই বরং তাঁদের একপেশে বিভক্তিতে ফেলবে। নায়ক হিসেবে বা খেলোয়াড় হিসেবে অবিসংবাদিত যে ইমেজ, তা নিশ্চিতই প্রশ্নের মুখে পড়বে। তাহলে কেন নির্দিষ্ট দলে নাম নিবন্ধন?
আমাদের এই সাবকন্টিনেন্টে ক্ষমতালিপ্সার ঔপনিবেশিক মনমানসিকতা ঝেড়ে ফেলতে আরো কয়েক শতাব্দী হয়তো পাড়ি দিতে হবে। তারপরও বাঙালি স্বার্থকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগী সেবক হয়ে উঠতে পারবে এমনটা আশা করা যায় না। আমরা বড় আত্মনিমগ্ন জাতি। সবার প্রাণ উজাড় করা অধিনায়কত্ব বা নায়কীয় ভালোবাসায় আমাদের পোষাচ্ছে না। আমরা এখন সংসদ সদস্য হবো, মন্ত্রী-মিনিস্টার হবো। কিন্তু তারপর? কবি গানেই বলেই দিয়েছেন, তার আর পর নেই নেই কোনো ঠিকানা!
আমরা অবশ্য চাই, মাশরাফি বা শাকিব খানরা নিজেদের স্টারডম বা তারকা গৌরব ব্যবহার করে শখের রাজনীতিক না হয়ে উঠুক। কেবল ক্ষমতাবিলাস না হোক তাঁদের আরাধ্য। তাঁদের পথ ধরে আগামীর বঙ্গবন্ধু বা বঙ্গতাজরা এই বাংলায় ফিরে আসুক। জাতির ক্রান্তিলগ্নে অমোঘ ঘোষণা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’র মতো করে মানবমুক্তির চেতনা ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে। তাঁদের পলিটিক্যাল আত্মনিবেদনের দীক্ষা হোক কবি সুনির্মল বসুর এই অমর পঙক্তি :
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।