চলচ্চিত্র
এমন ‘হাজির বিরিয়ানি’তে আমাদের রুচি নেই!
বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতা ধারণার চেয়েও অধিক, ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত বা মাদকের আগ্রাসনে যুবসমাজ অধঃপাতে নিমজ্জিত হচ্ছে ইত্যাকার নানা অশুভ বাক্যের সঙ্গে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। শিল্প-সাহিত্যে যেহেতু রোজকার জীবনের গল্পগাথাই প্রতিবিম্বিত হয়, সেখানে মাদক-সন্ত্রাসও জায়গা পেতেই পারে। তা দোষের কিছু নয়। কিন্তু বিদেশি আয়নায় যদি নিজের দেশের সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করতে চান, তার প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে, তা টের পাওয়া যাওয়া যাচ্ছে সদ্য নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দহনে’র ‘হাজির বিরিয়ানি’ উপভোগের পর।
দেশে ভয়াবহ মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চলমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলনের কালে যে ভাষায় ‘দহন’ ছবির প্রোটাগনিস্ট একজন মাদকাসক্তের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছে, তা এককথায় বিরল ও নেতিবাচক অর্থে অভাবনীয়। মদ, গাঁজা, চড়স, হেরোইন বা ইয়াবা আসক্ত ব্যক্তির আচরণ কেমন এবং পরিণতিই বা কী, তা আমরা কমবেশি জানি। মানবসমাজে চলচ্চিত্রের মতো সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী শিল্পানুষঙ্গের মাধ্যমে তা জাহির করবার অভিনবত্বের কোনো দরকার আছে বলে মনে হয় না। সোজাসাপ্টা ভাষাতেই বর্ণনা করা যায় মাদকের কুফল সম্পর্কিত বিষয়াবলি। অথচ আমাদের চলচ্চিত্রকাররা এখন দেশজ সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ না ধারণ করে উচ্ছন্নে যেতে বসা নতুন প্রজন্মকে খুব ভালো করে বুঝতে চাইছেন। সত্য ও সুন্দরের পূজারিরা তাদের টার্গেট অডিয়েন্স নন। তাদের পছন্দ এখন চটুল, প্রতিক্রিয়াশীল ও হুজুগে তারুণ্য, যারা ছবিতেও ইয়াবা-গাঁজা ধরনের মন্দ নেশার খোঁজ করে।
পরিচালক রায়হান রাফির ‘দহন’ ছবির শুটিং শেষ, এখন চলছে শেষ সময়ের সম্পাদনার কাজ। আগামি ১৬ নভেম্বর ছবিটি মুক্তি পাবে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে এই ছবির ‘হাজির বিরিয়ানি’ শিরোনামে একটি গান প্রকাশ করা হয়েছে ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে। প্রকাশের পর এই কলাম লেখার আগ পর্যন্ত গানটি দেখা হয়েছে এক মিলিয়নেরও অধিকবার। বিস্ময়করভাবে বেশিরভাগ দর্শক ভিডিওর নিচে গানটির ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন।
‘দহন’ সিনেমার সমালোচিত গানটির কথাগুলো এমন, ‘হাজির বিরিয়ানি/ মালে ঢাল পানি/ গাঁজা দেরে টানি/ চড়বে নেশা জমবে খেল/ থাকলে আমদানি/ মাতাল হয়ে হিসু করব দেয়ালে/ শালা যা হবে দেখা যাবে কাল সকালে।’ গানটির কথা লিখেছেন কলকাতার প্রিয় চট্টোপাধ্যায় এবং সংগীত পরিচালনা ও গেয়েছেন ওপার বাংলারই আকাশ সেন।
সত্য হলো, ঢাকার সিনেমায় এর আগে এমন কথার গান আগে কেউ শোনেনি। খুব স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনের অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা গানটিকে গল্পের প্রয়োজনে অনিবার্য বললেও আমাদের দেশের চলচ্চিত্রবোদ্ধারা একে অশ্লীল বলেই চিহ্নিত করছেন। প্রোগ্রেসিভ নেটিজেনরা ‘বাবা খেয়ে হাবা’ হয়ে নিজের খেয়ালে নর্দনকুর্দন করাকে রীতিমতো উসকানি হিসেবেই দেখছেন। ছবির পরিচালক রায়হান রাফি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ছবির স্বার্থেই এই গান। সংগীতাঙ্গনের বিক্ষুব্ধদের সঙ্গেও তাঁর দ্বিমত নেই। গানটি আমাদেরও যে খুব ভালো লেগেছে, তা কিন্তু নয়। গল্পের প্রয়োজনে গানটি করা। এই গানের মধ্যে ইয়াবা, মদ, গাঁজা, হিসুর মতো শব্দগুলো স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার বিষয় নয়। আমাদের এও বোঝা দরকার, এটি মাদক-সন্ত্রাসবিরোধী ছবি। একজন তরুণের মাধ্যমে মাদকের ভয়াবহতা তুলে ধরেছি আমরা।’ কিন্তু দহন সিনেমার নায়ক সিয়াম আহমেদ এবং প্রযোজক আবদুল আজিজ ইনিয়ে-বিনিয়ে সংক্ষুব্ধদের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের গানের পক্ষেই জোরালোভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন দিয়েছেন।
সমালোচকদের একটাই কথা, আধুনিক সময়ে বাংলাদেশের সিনেমায় এমন কথার একটি গান কীভাবে ব্যবহার করা হলো! গানটি শোনার পরপরই দেশের গীতিকবি, গায়ক, সংগীত পরিচালকসহ চলচ্চিত্র পরিচালকদের অনেকে লজ্জিত হয়েছেন। তারা নিজেদের ক্ষোভের কথা প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে।
গানটি নিয়ে ফেসবুকে নিজের কষ্টের কথা জানিয়েছেন সুরকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তিনি লিখেছেন, ‘এই দেশের সব দেয়ালেই ৩০ লাখ শহীদের পবিত্র রক্ত লেগে আছে। সেন্সর বোর্ডের সদস্যরা এমন অশ্লীল কথার গানের ছাড়পত্র দিলে তাঁদের ছবি ফেসবুকে তুলে ধরা হবে। বাবা শব্দের মানে হচ্ছে ইয়াবা, বর্তমান সরকার এই মরণনেশার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এই অসামাজিক গান বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হোক।’
‘ছবির গানে ক্ষুব্ধ সংগীতাঙ্গন’ শিরোনামে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো একটি খবর পরিবেশন করেছে। এই সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান এই গান প্রসঙ্গে বলেন, ‘চরম অবক্ষয়ে অস্তিত্বহীন হওয়ার পরই অস্তিত্ব খোঁজার পালা আসবে আবার। এখন অস্তিত্ব হারানোর দশা চলছে।’ কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এ ধরনের কথাসমৃদ্ধ গান মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।’ গুণী এই সংগীতব্যক্তিত্বের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মুস্তাফা জামান আব্বাসী, শেখ সাদী খান, এন্ড্রু কিশোর, বাপ্পা মজুমদার, ফোয়াদ নাসের বাবু, হাসান মতিউর রহমান, শওকত আলী ইমন, শফিক তুহিন, আনজাম মাসুদ, ফরিদ আহমেদসহ অনেকে। সংগীত গবেষক ও গুণী শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী এ ধরনের গানকে এক শব্দে ‘শোচনীয়’ বলে মন্তব্য করলেন।
আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে সরকার। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে আড়াই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী। বিনা দোষে কক্সবাজারের একরাম হত্যা নিয়ে বিরাট চাপও সামলাতে হয়েছে এলিট ফোর্স র্যাবকে। অভিযোগ আছে মাদকবিরোধী যুদ্ধের আড়ালে চলছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড! মাদক নিয়ন্ত্রণে মানবাধিকারভিত্তিক কৌশল নির্ধারণে খোদ জাতিসংঘেরও নির্দেশনা রয়েছে। তার পরও দেশে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বার্মিজ ইয়াবা ব্যবসার রাশ টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। এমন বাস্তবতায় মাদক-সংক্রান্ত ইস্যু উসকে দিয়ে একজন চলচ্চিত্র নায়কের মুখ দিয়ে অশ্লীল ও অশ্রাব্য কথামালায় সাজানো গান ও নৃত্যের উন্মাদনা তাই অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
দহন চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, ছবি মুক্তি পাওয়ার পর এই গানের উপযোগিতা খুঁজে পাবে দর্শকরা। কিন্তু কোনো বাস্তবতাতেই কি মাতাল হয়ে দেয়ালে প্রস্রাব করবার উপযোগ্যতা থাকা উচিত? আসলে আর কত নিচে নামা বাকি আমাদের? তাহলে সামনের কোনো সিনেমায় কি একজন ধর্ষক বা খুনির ক্যারেক্টার বোঝাতে ছবির মূল চরিত্রের মুখ দিয়ে গাওয়ানো হবে, ‘আমি ধর্ষণ করে খুন করব আপন খেয়ালে/ শালা যা হবে তা দেখা যাবে কাল সকালে!’
কলকাতার প্রিয় চট্টোপাধ্যায় বড় গীতিকার। বহু ভালো গানের স্রষ্টা তিনি। কিন্তু ‘হাজির বিরিয়ানি’ গানের মুখরাতে যে নোংরামিটা করা হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে নিম্নতর রুচির পরিচায়ক। এমন গান তিনি কলকাতাতেও খাওয়াতে পারতেন না। অথচ গানটার র্যাপ অংশে বেশ কয়েক লাইন প্রাসঙ্গিক সত্য আছে। চোর পুলিশের খেলায় জনগণ মারা পড়ছে কিংবা নষ্ট সিস্টেমে আসল চোর চুরি করে দিনে দুপুরে, সত্যি বললে গুলি খাবি পাঁজরে। কড়ি ফেললে এবং তেল মাখলে অনেক কিছুই মেলে এখানে। এর অর্থ এই নয় আপনি ইয়াবা-গাঁজা খেয়ে মাতাল হয়ে সভ্যতা ও রুচির দেয়ালে প্রস্রাব করে দেবেন!
নষ্টকালের স্রোতে মগজ ও বিবেক ভাসিয়ে আকাশ সেনের সঙ্গে সমস্বরে, ‘যা আছে কাল দেখা যাবে সকালে!’ বলে যুবকদের বেয়াড়াপনা শেখাচ্ছেন, তারা কি বাংলাদেশের ইতিবাচক কিছু চোখে দেখেন না? তারা কি এই উপমহাদেশের অন্য পুরোনো দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নবীন বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া অবলোকন করেন না?
গানের শেষাংশ অনুযায়ী বিলেতি মদ খেয়ে সখী সহবতে নিজের খেয়ালে বাঁচার নাম জীবন হতে পারে না। অন্যের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করে, সবার মূল্যবোধে শ্রদ্ধাশীল থেকে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে যে যাপিত জীবন তা সুন্দর ও মহত্তম। শিল্পের আরাধ্য বরাবরই মহিমান্বিত জীবনবোধ।
হতে পারে মানুষ উপলব্ধির ক্ষুধায় ক্ষুধিত এবং বাস্তব জগতে যাকে সে সর্বতোভাবে বর্জনীয় বলে জানে, সাহিত্যে তাকেও সে পেতে চায়। কিন্তু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সাহিত্যের পথে’ প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদই আমাদের কাছে প্রণিধানযোগ্য। যেখানে তিনি বলেন, ‘মানুষের সব উপলব্ধিই তুল্যমূল্য নয়। কোনো কোনো উপলব্ধি মূল্যবান, কোনো কোনোটি তা নয়। সাহিত্যে সেই উপলব্ধিগুলোকেই বেছে নিতে হবে, যেগুলো যথার্থই মূল্যবান। যা মূল্যহীন, যা ক্ষতিকারক, যা কুপথ্য, তাকে বর্জন করতে হবে।’ রবীন্দ্রদর্শন অনুযায়ী দহন শিল্পগোষ্ঠী ভবিষ্যতে আপনাদের বাছবিচারবুদ্ধি শাণিত হবে এবং আমাদের তরুণ প্রজন্ম আপনাদের হাত থেকে রক্ষা পাবে এমন প্রত্যাশা রাখি। আপনাদের অবিবেচনার বেখেয়ালে আর এতটুকু নষ্ট না হোক সভ্যতা ও রুচির দেয়াল।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।