কোরবানির ঈদ
মৌসুমি প্রতিবেদন ও পশুর চামড়া প্রসঙ্গে
সব এলাকার সাংবাদিকদের মতো যশোর অঞ্চলের সাংবাদিকদেরও কিছু ‘সিজনাল রিপোর্ট’ বা মৌসুমি সংবাদ তৈরি করতে হয়। একইভাবে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ এলেই প্রতি বছর গরু আর তার চামড়া নিয়ে গবেষণায় নেমে পড়েন যশোরের সাংবাদিকরা। সীমান্ত দিয়ে গরু কেমন আসছে। তাতে চাহিদা মিটবে কি না। দাম কেমন হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার অবশ্য বিশেষ কারণে এ রিপোর্টের চাহিদা একটু বেশি ছিল। সাংবাদিকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় ঈদের কয়েকদিন আগে থেকে। কারণ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চামড়ার হাটটি (স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী) যশোরে। রাজারহাটে। এখানেও একই অবস্থা। বছরের পর বছর ধরে সেই একই রিপোর্ট। পার্থক্য কেবল উনিশ আর বিশ। সামান্য একটু ঘষামাজা আরকি।
ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়ার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা পাওনা, ব্যাংকঋন না পাওয়া, চামড়া কেনার সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের হাতে টাকা না থাকা, আর স্বাভাবিকভাবেই যেসব মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী পাড়ামহল্লা থেকে বেশি দাম দিয়ে চামড়া সংগ্রহ করেন তাঁদের বড় ধরনের ধরা খাওয়া। ফলাফলসরূপ মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাঁদের পুঁজি বাঁচাতে চামড়া তুলে দেন পাচারকারীদের হাতে। মোটামুটি এই হলো রিপোর্টের বিষয়বস্তু। বছরের পর বছর সাংবাদিকরা যে একই রিপোর্ট উনিশ-বিশ করে লিখছেন, এটা কী সাংবাদিকদের দোষ? নাকি এসব সমস্যার সমাধান যাঁদের করার কথা, তারা করছেন না, তাঁদের দোষ?
রাজারহাটে চামড়ার হাট বসে সপ্তাহে দুইদিন। শনি আর মঙ্গলবার। এখানে চামড়ার আড়ৎ রয়েছে দুইশরও বেশি। কোরবানির ঈদের পরের দুই-তিনটি হাট বছরের মধ্যে সবচে জমজমাট হয়। এই দুই-তিন হাটে চামড়া কেনা-বেঁচা হয় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার। যশোর ও আশপাশের এলাকা, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুরসহ অনেক জেলা থেকেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চামড়া তোলেন এ হাটে।
এখানকার চামড়া ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও সেই একই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তাঁরা। বৃহত্তর যশোর জেলা (যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল) চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আশরাফ আলী বললেন, গতবছর কোরবানির ঈদের স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো চামড়া কিনতে পারেননি। কারণ ট্যানারি মালিকদের কাছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পুঁজি আটকে ছিল। এবারও তাই হয়েছে। ঈদের মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও এখনো এখানকার ব্যবসায়ীদের গত বছরের চামড়ার প্রায় ১০ কোটি টাকা ট্যানারি মালিকদের কাছে আটকে আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাংকঋন পান না। এ অবস্থায় স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ীরই এবারের কোরবানির ঈদে চামড়া কেনার সামর্থ্য এবার থাকবে না। একই সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন মুকুল অভিযোগ করে বললেন, চামড়া কেনার জন্য সরকার ট্যানারি মালিকদের কোটি কোটি টাকা ঋন দেয়। সেই টাকা তারা চামড়া খাতে ব্যয় না করে অন্য খাতে ব্যয় করেন। কোরবানির সময় এলে তাদের হাতে টাকা থাকে না। তখনই তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দেন। এবারও তেমনটিই হবে বলে আলাউদ্দিন মুকুল আশঙ্কা করছেন। তিনি বলেন, পাচারকারীরা মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের স্থানীয় বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দাম দিয়ে থাকেন। সে কারণে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা তাদের সংগৃহীত চামড়া পাচারকারীদের হাতে তুলে দেন। তবে এবার চামড়া পাচার কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা হবে বলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে বলে জানান আলাউদ্দিন মুকুল। স্থানীয় চামড়া ব্যবসায়ী তারাপদ দাসও মোটামুটি একই আশঙ্কার কথা বললেন। তিনি মনে করছেন, মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পেশাদার চামড়া ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটের সুযোগ নেবেন। তাঁরা পাড়া-মহল্লা থেকে বেশি দামে চামড়া সংগ্রহ করবেন। পরে হাটে এসে চাহিদামতো দাম না পেয়ে পাচারচক্রের হাতে তাঁদের চামড়া তুলে দেবেন।
তবে চামড়া পাচার ঠেকাতে পুলিশ ও বিজিবি এবার কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছে। পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান বলেন, কোনোভাবেই যাতে চামড়া পাচার না হয় সেজন্য সীমান্তবর্তী থানাগুলোকে সতর্ক দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যশোর বিজিবির কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সীমান্তে বিজিবি সতর্ক অবস্থানে আছে। চামড়া পাচার ঠেকাতে সীমান্তে অতিরিক্ত টহলের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এসব করে চামড়া পাচার হয়তো ঠেকানো যাবে, কিন্তু এখানকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সমস্যাগুলোর সমাধান করবে কে? নাকি প্রতিবছর যশোরের সাংবাদিকদের সেই একইভাবে প্রতিবেদন লিখতে হবে?
লেখক : সাইফুল ইসলাম সজল,স্টাফ করসপনডেন্ট, যশোর, এনটিভি