স্মরণ
কান্না লুকিয়ে চলে গেলেন আইয়ুব বাচ্চু
রুপালি গিটারের অবিসংবাদিত সুরবিধাতা তাঁর শৈল্পিক আঙুলের ছন্দোবদ্ধতায় যখন সুরের ইন্দ্রজাল ছড়াতেন ভক্তকুল এক অনির্বচনীয় অন্যজাগতিক মূর্ছনায় মেতে উঠতেন। প্রকৃতিও তেমন সুরসুধায় মুগ্ধ হতো কি? পাখিরাও মজে থাকত কি গিটারের অমন টুংটাং কুহকে? তা না হলে আজ দিনটা এমন বিষণ্ণ বেদনাবিধুর হলো কী করে? কান্নার অশ্রুজল ভূতল স্পর্শ করল কী করে? অসীম এক পুণ্যস্থান থেকে ঐশ্বরিক সুর নিয়ে এসে ভক্তের হৃদয়ে ঢেউ তুলতেন যিনি, উদ্দীপ্ত করতেন যিনি, সেই অমর সুরস্রষ্টা আইয়ুব বাচ্চু তাঁর হৃদয়ের কাছে দুঃখের নৈবেদ্য রেখে উড়াল দিলেন আকাশে। গভীর শ্রদ্ধা ও অনিঃশেষ ভালোবাসা প্রিয় শিল্পী।
অমরত্বের গান গেয়ে যিনি গানপাগল এক প্রজন্ম রেখে যেতে পারেন সেই অবিনাশী শিল্পীর মৃত্যু নেই। যুগযুগান্তরে অমোঘ সেই শিল্পের জোয়ারেও কখনো ভাটা নামবে না। আইয়ুব বাচ্চুর সুরের জাদু মিশে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
ট্র্যাজেডি তথা বিয়োগান্তক সুরের ধ্রুপদি সম্রাট ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। সুরপিয়াসীদের ভরা জলসায় তিনি দুচোখ মুদে গিটারে হাত রাখলেই চারপাশে কারুণ্যের ঝড় বয়ে যেত। বিবাগী হয়ে যেত স্রোতা দর্শকের মন। প্রাণস্পর্শী তেমন নিস্তব্ধতায় দয়িতার কাঁধে মাথা রেখে কান্না করবার উপলক্ষ সৃষ্টি হতো। হৃদয়ছোঁয়া সুরে বুঝি এমন করে আর কেউ উচ্চাঙ্গ মৌনতায় ভরিয়ে দিতে পারত না। সুরের এই কবির ব্যথা কি আমরা অনুভব করতাম? চেনার মতো চিনতে পারতাম? নিজেকে ঢেলে দিয়ে আমাদের সুখী করতেন। উৎসব আলোকিত করতেন। আমরা কি খবর রাখতাম কতটা মোমের আঁচে নিঃসঙ্গ শিল্পী পুড়ে চলেছেন? কত গানে এঁকেছেন নির্ঘুম প্রহর? কী এক বিচ্ছেদের বিয়োগ ব্যথায় নিজের মধ্যেই যেন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন। তিনি গীতিকবি লতিফুল ইসলাম শিবলীর কথায় গিটারে অমৃত ভাষা দিয়ে যেমনটা বলতেন :
হাসতে দেখ গাইতে দেখ
অনেক কথায় মুখর আমায় দেখ
দেখো না কেউ হাসির শেষে নীরবতা।
আমার সুরের বুকে কান্না লুকিয়ে থাকে
আমার চোখের কোনে নোনা ছবি আঁকে...
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা আইয়ুব বাচ্চু একাধারে গায়ক, লিড গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন। এলআরবি ব্যান্ড দলের লিড গিটারিস্ট এবং ভোকাল বাচ্চু বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিদের একজন। তাঁর গাওয়া ‘রুপালি গিটার’, ‘রাত জাগা পাখি হয়ে’, ‘মাধবী’, ‘ফেরারি মন’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘বার মাস’, ‘হাসতে দেখ’, ‘উড়াল দেব আকাশে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘সেই তুমি কেন অচেনা হলে’, ‘একদিন ঘুম ভাঙা শহরে’, ‘মেয়ে ও মেয়ে’, ‘কবিতা সুখ ওড়াও’, ‘এক আকাশ তারা’, ‘সে তারা ভরা রাতে’, ‘সুখের পৃথিবী’ গানগুলো ঘুরেছে মানুষের মুখে মুখে।
১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। এরপর একে একে ‘ময়না’, ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘কষ্ট’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘বলিনি কখনো’, ‘যুদ্ধ’ এবং সর্বশেষ ২০১৫ সালে ‘জীবনের গল্প’ বাজারে আসে। চলচ্চিত্রেও প্লেব্যাক করেছেন তিনি। ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও’ আমাকে গানটি চলচ্চিত্রপ্রেমীরা এখনো মনে রেখেছেন।
১৯৭৮ সালে সংগীতজীবন শুরু করেন আইয়ুব বাচ্চু। সোলসের হয়ে ব্যান্ড সংগীতে পা রাখার পর ১৯৯০ সালে নিজের ব্যান্ড দল প্রতিষ্ঠা করেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ডের নাম রাখেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে এর নাম বদলে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’।
‘সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে’ আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় এই গানটি বাঙালি এক প্রজন্ম তাদের ‘লাভ অ্যান্থেম’ বানিয়ে রেখেছিল। রোজ কতশত গান আসছে যাচ্ছে। বুকের গভীরে এক সাগর কান্না নিয়ে পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে নিজের ভুলে হারিয়ে ফেলা প্রিয়াস্পদকে কবে কে আর এমন করে বলতে পেরেছে? ভুলে যাওয়ার ভাবনাটা যে আরো মনে পড়ার গভীরতায় নিমজ্জিত করে, আইয়ুব বাচ্চু সুর না তুললে আমরা কি তার সত্যিকারের মর্মটা কোনোদিনই বুঝতে পারতাম? তিনি যদি দরদি গলায় সবটুকু আবেগ ঢেলে দিয়ে না গাইতেন তবে আমরা কি জানতাম ‘তুমি ছাড়া এই আমি বড় অসহায়’ :
তুমি কেন বোঝ না
তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়,
আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে।
আমার অপরাধ ছিল যতটুকু তোমার কাছে
তুমি ক্ষমা করে দিও আমায়।
এখনো নিশুত রাতে ঝিরিঝিরি বাতাসে প্রিয় মানুষটিকে না পাওয়া দয়িত অথবা দয়িতা অপেক্ষার প্রহর গুনবে বাচ্চুর হৃদয় খুঁড়ে বেদনাজাগানিয়া মিউজিক শুনতে শুনতে। দুঃখের সাগর মন্থন করে প্রবোধ খুঁজবে আইয়ুবীয় সুরলহরিতে :
এখন অনেক রাত
খোলা আকাশের নিচে
জীবনের অনেক আয়োজন
আমায় ডেকেছে
তাই আমি বসে আছি
দরজার ওপাশে, দরজার ওপাশে…
প্রেমের সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পাড়ি দিতে দিতে ভক্তকে কাঁদতে শিখিয়েছিলেন বাচ্চু। অনুভব করতে শিখিয়েছিলেন কষ্টের বিহ্বলতা। হাজার অভিলাষ ও শত অভিমান নিজের বুকে জমিয়ে ভালোবাসা আর বিয়োগব্যথার যুগলবন্দিতে বাউল করে দিয়েছিলেন আমাদের মতো ভক্তের মন। আমরা এখন প্রেমের মরা গাঙেও জোয়ার তুলতে শিখে গেছি হে প্রিয় শিল্পী। আর সেই ভাবসাগরের জলযানে হাল ধরা অমর সারেং তো আপনিই গুরু। সে আপনি অভিমান করে বড় অকালে আকাশ উড়াল দিলেই কীই-বা?
গত ১৬ আগস্ট নিজের জন্মদিনে আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘এমন কিছু গান করতে চাই, যা আগে কখনো করিনি। এই গানগুলো নিজে লিখব, সুর করব ও গাইব।’ আপনার শেষ ইচ্ছে হয়তো পূর্ণ হলো না সত্যি, কিন্তু সুরের যে মায়াজাল আপনি ছড়িয়ে রেখে গেছেন, সেখানে অপূর্ণতা বলে কিছুই নাই। আপনার সুর অবিনশ্বর। আপনার অদ্বিতীয় গিটারিক সুর ও বাণীর যূথবদ্ধতা আমাদের ভালোবাসার হৃদমন্দিরে অমর অক্ষয় অর্ঘ্য হয়ে থাকুক। সুরের বুকে লুকিয়ে থাকা কান্নায় আমরা যেন ভিজে চলি নিরন্তর।
তাই বলি কেউ না জেনে
ব্যথা দিও না কারো মনে
কারো মনে দুঃখ দিয়ে সুখ তো পাবে না...
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।