জাতীয় নির্বাচন
জোটের হিসাব কি ভোটের হিসাবে?
‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ ইস্যুতে জমে উঠছে রাজনীতির মাঠ। বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বাদ দিয়ে বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নাটকীয়ভাবে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ ঘোষণা করার বিষয়টি সারা দেশে অত্যন্ত আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। একটি বৃহৎ জোট গঠনের লক্ষ্যে তথাকথিত যুক্তফ্রন্টের অন্যতম দল বিকল্পধারার মূল শর্ত ছিল জামায়াত তথা স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠনসমূহকে বাদ রাখা। অন্যদিকে যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য দলের এ বিষয়ে কৌশলী অবস্থান লক্ষ করা গেছে। এর ফলস্বরূপ নানা নাটকীয়তার পর বিকল্পধারা ছাড়াই ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের ঘোষণায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ জমে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারপক্ষ ও সরকারবিরোধী পক্ষ বেশ নড়ে চড়ে বসেছে।
বেশ কিছুদিন থেকে আমরা লক্ষ করেছি, বৃহৎ জোট গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াত ইস্যুটি অন্যতম ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনে এখন আর এই দলটি নিবন্ধিত না হলেও ভোটের হিসাব-নিকাশে এই দলের বিশেষ গুরুত্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই জামায়াত ইস্যুতে নিজেদের অবস্থানকে স্পষ্ট রেখেছে। বিএনপি জামায়াতের ব্যাপারে নিশ্চুপ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অবস্থান জামায়াতবিরোধী। মোটা দাগে বলা যায়, দেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই জামায়াতকে ভোটের রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হিসেবে বিবেচনা করে। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। এই দলের নিবন্ধন না থাকলেও পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে ভোটের হিসাবে তাদের একটা বিশেষ দখল রয়েছে। এ ছাড়াও ’৯০ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এই দলকে বিশেষ ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে। বিশেষ করে বিএনপির অন্যতম রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গত দেড় দশকের বেশি সময় জামায়াতের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন-পরবর্তী প্রায় সব নির্বাচনে জামায়াতকে বড় ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হতো। স্থানীয় নির্বাচনেও দলটির প্রাপ্ত ভোটের ফলাফলেও এর প্রমাণ আছে। এর বাইরে আরো কিছু ইসলামী সংগঠনের সারা দেশে কিছু ভোট আছে। নির্বাচন সামনে রেখে এসব দলের সঙ্গেও যোগাযোগ শুরু করেছে মূলধারার দলগুলো। কারণ ইসলামী দলগুলোর ভোটে নির্বাচনী রাজনীতির গতি নির্ধারিত হতে পারে।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দুটি আসন পেয়ে ৪.৭০ শতাংশ ভোট, ২০০১ সালের নির্বাচনে ১৭টি আসন পেয়ে ৪.২৪ শতাংশ, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনটি আসন পেয়ে ৮.৬১ এবং ১৯৯১ সালে ১৮টি আসন লাভ করে ১২.১৩ শতাংশ ভোট পায়। আসন যাই পাক জামায়াতের নির্দিষ্ট একটি সংখ্যার ভোট বেশিরভাগ আসনেই আছে। এ ছাড়া নতুন হিসাবে ৪০ হাজার কওমি মাদরাসায় নতুন-পুরোনো ৮৫ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থী আছে। তাদের পরিবারে দুজন করে সদস্য হলেও প্রায় দেড় কোটির ওপর ভোটার আছে। আপাত দৃষ্টিতে জামায়াতের যেমন ৬-৯ শতাংশ ভোট রয়েছে, তেমনি কওমি পরিবার কিংবা হেফাজতেরও একটি নির্দিষ্ট ভোট রয়েছে যেগুলো নির্বাচনী রাজনীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পারে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত ব্যতীত ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর কারোই প্রাপ্ত ভোট ১ শতাংশও ছুঁতে পারেনি। কাজেই জামায়াত ও হেফাজতের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে যেকোনো সমীকরণ আসতে পারে।
আর এ কারণেই নানা প্রতিকূল অবস্থাতেও বিএনপি জামায়াত প্রসঙ্গে কোনো ধরনের আপস রফায় যেতে চায় না। এমনকি জামায়াতের গায়ে যুদ্ধাপরাধীর তকমা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি এই দলকে ত্যাগের কোনো ঘোষণা দেয়নি। আবার সরকারবিরোধী অবস্থানকে পাকাপোক্ত করতে যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী জোট গঠনের নিমিত্তে ছোট দলগুলোর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। এই সূত্র ধরেই, যে দলগুলোর সারাদেশে একটি আসন পাওয়ার যোগ্যতা কিংবা সামর্থ্য নেই, বৃহৎ জোট গঠনের লক্ষ্যে সেই দলগুলোর গুরুত্ব বেড়েছে যথেষ্ট।
এসব প্রেক্ষাপট থেকে দেশের প্রধান দুটি দলকেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠনগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর বিশেষ কদর লক্ষ করা গেছে। জাতীয় ঐক্যজোট গঠনের ক্ষেত্রে জামায়াত ইস্যুটি অন্যতম হিসেবে আমরা লক্ষ করেছি।
নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি যেমন জামায়াতকে ছাড়তে চায় না, তেমনি আওয়ামী লীগও হেফাজত কিংবা ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে এক ধরনের সখ্যতা গড়তে চায়। মূলত নানাবিধ কৌশল রক্ষা করেই আগামী নির্বাচনে বড় সাফল্য পেতে চায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই। বিকল্প ধারার অন্যতম শর্ত ছিল জামায়াতকে বাদ দিয়ে বৃহৎ ঐক্য প্রতিষ্ঠা। আর বিএনপি জামায়াতকে বাদ দিয়ে এই ঐক্যে আগ্রহী ছিল না। ফলে এই মুহূর্তে বিকল্পধারাকে বাদ দিয়ে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠনের ফলে স্বস্তিবোধ করছেন ২০ দলীয় জোটের শরিকরা। বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও এতে সন্তুষ্ট। বিএনপি এখন মনে করছে সরকারবিরোধী এই জোট নানা সমীকরণে তাদের নির্বাচনী বৈতরণী পারি দিতে বিশেষ সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে। অন্যদিকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হলেও ভোটের সমীকরণে তারা কিছুটা নড়ে চড়ে বসেছে। কারণ যে কোনোভাবেই সরকারবিরোধী জোটটি বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠলে নির্বাচনে একটি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি হবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্যদিকে নির্বাচনে আরো একটি শক্তি হিসেবে জাতীয় পার্টি কতটুকু অবস্থান করে নিতে পারবে এবং কতগুলো আসনে বিজয়ী হতে পারবে তা নিয়েও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিশেষ হিসাব অব্যাহত রয়েছে। আগামীতেও সরকার গঠনের জন্য নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন নিশ্চিত করতে জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দেবে। আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে সংসদে বর্তমান প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে সুবিধাজনক অবস্থানেই পেতে চায়। কাজেই দেশের রাজনীতিতে জোটের সমীকরণ কীভাবে মিলবে কিংবা আদৌ মিলবে কি না, সেই হিসাব ধরেই এগিয়ে চলেছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে কোনটি আদর্শ আর মতাদর্শ সেই সমীকরণে স্থির থাকছে না। সমীকরণ এখন একটাই, সেটি হলো ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা ক্ষমতায় থাকা।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।