জাতীয় নির্বাচন

ইভিএম-এর আদ্যোপান্ত

Looks like you've blocked notifications!

ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের সম্ভাব্যতা এবং এর কারিগরি বিষয় নিয়ে প্রথমে ধারণা পাই নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনে। তখন নির্বাচন কমিশন বিটের রিপোর্টার হিসেবে বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক লুৎফুল কবিরের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কথা হয়—যিনি এই মেশিন ‘উদ্ভাবনের’ (আসলে বাংলাদেশীকরণ) সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

২০০৯ সালের ৬ অক্টোবর ইভিএম নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণাপত্র পেশ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি বিভাগ—যারা এর দুই বছর আগে, অর্থাৎ ২০০৭ সালে মেশিনটি বাংলাদেশে উদ্ভাবন করে। যদিও এর আগে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন পরিচিত ছিল।

দেশে এই মেশিনে সর্বপ্রথম ভোট নেওয়া হয় ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে এবং সেখানে এই মেশিনের সাফল্য সবাইকে অভিভূত করে মূলত এর দ্রুতগতির গণনায়। ভোট গ্রহণের মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে ফল ঘোষণা দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় একটা বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় এবং ওই মেশিনে কারচুপি হয়েছে—এমন অভিযোগও ওঠেনি।

বস্তুত হুদা কমিশন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারে যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছিল, ইভিএম তার অন্যতম। যদিও তাদের আমলে এই মেশিনের খুব বেশি প্রয়োগ তারা করতে পারেনি। শুধু ইভিএম নয়, নির্বাচন কমিশন গঠনেও তাদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। ফলে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনের পদ্ধতি চালু করা হলেও বিতর্ক এড়ানো যায়নি। পাঁচ সদস্যের বড় কমিশন গঠনেও তাদের মত ছিল না। বরং তাঁরা মনে করতেন, তিন সদস্যই যথেষ্ট এবং এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।

ইভিএম প্রসঙ্গে আসা যাক। যেসব কারণে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে পছন্দ করা হয় তা হলো—এই পদ্ধতিতে ভোট নিলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে ব্যালট পেপার ছাপানো, কালি, ভোটগণনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকবল এবং সময় বাঁচে। বলা হয়, এই মেশিনে ভোট গ্রহণ এবং গণনা হয় নির্ভুল। নির্বাচনের ফল দেওয়া যায় ব্যালট পেপারের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুততায়। এই পদ্ধতিতে ভোট বাতিলের সুযোগ নেই—যা আছে ব্যালট পেপারে। অর্থাৎ কেউ একাধিক প্রার্থীকে ভোট দিলে কিংবা সঠিক জায়গায় সিল না মারলে যেমন ভোট বাতিল হয়, ইভিএমে তার সুযোগ নেই। কারণ নির্ধারিত প্রতীকের সুইচে যখন কেউ চাপ দেবেন, সেটি সঙ্গে সঙ্গে মেশিনের মেমরিতে চলে যাবে। এই মেশিনের আরেকটি সুবিধা, কেন্দ্র দখল করে ভোটের ফল পাল্টে দেওয়ার সুযোগ নেই।

এযাবৎ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্বল্প পরিসরে এই যন্ত্রের ব্যবহার হলেও সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক আকারে অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়নি। তবে এযাবৎ যতগুলো নির্বাচনে এই মেশিনের ব্যবহার হয়েছে, সেখানের অভিজ্ঞতা ব্যালট পেপারের চেয়ে ভালো। সবশেষ সিটি নির্বাচনেও যতগুলো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়েছে, সেখানে ব্যালট পেপারে ভোট নেওয়া কেন্দ্রের চেয়ে দ্রুত ফল পাওয়া গেছে। তা ছাড়া এই মেশিন হ্যাক করা হয়েছে বা কারচুপি হয়েছে—এমন অভিযোগও কেউ করেননি। কিন্তু তারপরও এই যন্ত্র নিয়ে বিতর্ক চলছে—যার নেপথ্যে মূল কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থাহীনতা। যে আস্থাহীনতার কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করতে হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই পদ্ধতি বাতিল করা হলেও যে প্রেক্ষাপটে এই বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল, সেই রাজনৈতিক বাস্তবতার কোনো হেরফের হয়নি। সেটি অন্য তর্ক।

ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক তর্কে যাওয়ার আগে এর কারিগরি দিক সম্পর্কে আরেকটু আলোকপাত করা যায়। এই মেশিনের কন্ট্রোল ইউনিট থাকে পোলিং অফিসারের হাতে। সেই ইউনিটে ব্যালট নামের একটি সুইচ থাকে। সুইচটি চেপে পোলিং অফিসার ভোটারকে ভোট দিতে বুথে পাঠান। কন্ট্রোল ইউনিটের ব্যালট সুইচটি চাপার মাধ্যমে ব্যালট ইউনিটটি একটি ভোট নেওয়ার জন্য কার্যকর হয়। ভোটার ভোট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যালট ইউনিটটি ফের অকার্যকর হয়ে যায়। ফলে কেউ যদি একাধিকার সুইচ চেপে একাধিক ভোট দেওয়ার চেষ্টা করেন, তা সফল হবে না। তবে পোলিং অফিসার কন্ট্রোল বাক্সের ব্যালট সুইচ চেপে নতুন করে ব্যালট বাক্স কার্যকর করতে পারেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই মেশিনে যদি কোনো পোলিং অফিসার অসদুদ্দেশ্যে অনেক ভোট দিতে চান, সেটি খুব জটিল প্রক্রিয়া। তা ছাড়া ভোটকেন্দ্রে যখন সব দলের পোলিং এজেন্ট থাকবেন, সেখানে পোলিং অফিসার চাইলেও নিজের মতো ভোট দিতে পারবেন না।

তবে কেন্দ্রে যদি সব দলের এজেন্ট না থাকেন, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এখানেও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ডিসপ্লে ইউনিট। অর্থাৎ বুথের বাইরে যে ডিসপ্লে ইউনিট ঝোলানো থাকে, সেখানে যে কেউ দেখতে পারেন কতজন ভোটার বুথে ঢুকলেন এবং কতগুলো ভোট ওই ডিসপ্লেতে দেখানো হচ্ছে। কোনো পোলিং অফিসার যদি অবিশ্বাস্য রকম দ্রুততায় এবং বুথে ভোটার না পাঠিয়েই ব্যালট সুইপ চাপতে থাকেন, তখন ডিসপ্লেতে এটি দেখা যাবে। অর্থাৎ এই ডিসপ্লে ইউনিট ইভিএমের আয়না হিসেবে কাজ করে। এখন যারা ইভিএমের বিপক্ষে বলছেন, তাঁরা বরং ইভিএমের বিপক্ষে না বলে এর কারিগরি দিকগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগের দাবি জানাতে পারেন। কারণ কাগজের ব্যালটের চেয়ে বেশি মেশিনে জালিয়াতি করা কঠিন।

কিন্তু যেসব রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমের বিরোধিতা করছেন, তারা বলছে, এই মেশিন হ্যাক করা যায় এবং ফলাফল পাল্টে দেওয়া যায়। মূলত একধরনের আশঙ্কা থেকেই তাঁরা এর বিরোধিতা করছেন।

বিরোধীদের কারো কারো আশঙ্কা, ইভিএমে আগেই সুইচ টিপে ভোট দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মেশিনের কন্ট্রোল ইউনিটে রেজাল্ট নামে একটি সুইচ আছে। এটিতে পরপর চাপ দিলেই একে একে সব প্রার্থীর বিপরীতে কত ভোট মজুদ আছে, তা জানা যায়। অর্থাৎ আগে থেকেই কোনো প্রার্থীর বিপরীতে ভোট দেওয়া হয়েছে কি না, তা এই সুইচে চাপ দিলেই জানা সম্ভব এবং পোলিং অফিসার ভোট গ্রহণ শুরুর আগে নিশ্চয়ই এই পরীক্ষা করে নেবেন। এই মেশিনের মেমরি এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, কেউ মেশিন ভেঙে ফেললেও এতে কোন প্রার্থীর অনুকূলে কতগুলো ভোট পড়েছে, তা উদ্ধার করা সম্ভব।

এত কিছুর পরও ইভিএমে সব রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে সরকারবিরোধী পক্ষের আস্থা নেই। এই আস্থাহীনতা আসলে মেশিনের ওপর নয়; বরং আস্থার সংকট দলে দলে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে। বলা হয় মেশিন যেমনই হোক, এর প্রয়োগ নির্ভর করে এর পেছনের ব্যক্তিটি কে, অর্থাৎ মেশিনটি কে চালাচ্ছেন তার ওপর। যে কারণে বলা হয় ‘ম্যান বাহাইন্ড দ্য মেশিন’।

যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পরকে বিশ্বাস করে না—যেহেতু এ দেশে ক্ষমতা হচ্ছে সেই বাঘের পিঠে সওয়ার হওয়ার মতো, যার পিঠ থেকে নেমে গেলে সেই বাঘের পেটে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে—ফলে কেউ বাঘের পিঠ থেকে নামতে চায় না। চায় না বলেই নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিধান সংবিধানে যুক্ত করতে হয়; চায় না বলেই ওয়ান-ইলেভেনের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগ আসে; চায় না বলে পেট্রলবোমায় নিরীহ মানুষের প্রাণ যায়; চায় না বলেই ইভিএমের মতো যন্ত্রকেও তারা বিশ্বাস করে না। এই বিশ্বাসের ঘাটতি মূলত তাদের নিজেদের।

তবে এ নিয়ে সাম্প্রতিক তর্কের পেছনে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি ছাড়াই আগামী জাতীয় নির্বাচনের এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ একশ আসনে ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের তড়িঘড়ি অনেকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। অথচ এই কমিশনই বলেছিল, সব দল আস্থায় না নিলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ করে কী এমন ঘটল যে নির্বাচন কমিশন একশ আসনে ইভিএম ব্যবহারে প্রস্তুত বলে জানাল? প্রশ্নটি যে শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ তা-ই নয়, বরং খোদ নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যেও এ নিয়ে মতভিন্নতা আছে এবং আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার সম্প্রতি কমিশনের বৈঠকও বর্জন করেছেন। তিনি আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার পেছনে মোটাদাগে তিনটি যুক্তিও তুলে ধরেছেন।

সুতরাং মেশিন হিসেবে ইভিএম যত আধুনিক এবং সুরক্ষিত হোক না কেন—যদি নির্বাচনে অংগ্রহণকারী সব দল এই মেশিনে আস্থাশীল না হয় এবং নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে এ বিষয়ে মতৈক্য তৈরি না হয়, তাহলে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার মানে হয় না। তবে গোটা তিরিশেক আসনে ব্যবহার করা যায় এবং সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোর ভোটারদের এই মেশিন ব্যবহারের বিষয়ে অবহিত করার মতো যথেষ্ট সময় ইসির হাতে আছে কি না, তাও ভেবে দেখা দরকার। সেইসঙ্গে এই মেশিন ক্রয়ের সঙ্গে যেহেতু রাষ্ট্রের অনেক অর্থ জড়িত—সুতরাং সেখানেই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি।

আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক।