অভিশংসন
বিচারপতির বিচার ও সাংবিধানিক গোলকধাঁধা
বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাস তো বটেই, পুরো দেশের জন্যই এটি একটি অভূতপূর্ব এবং বিস্ময়কর ঘটনা যে, প্রধান বিচারপতির ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছেন আপিল বিভাগের একজন ‘আলোচিত’ বিচারপতি। বস্তুত আমাদের সংবিধানে (১৬তম সংশোধনী অনুযায়ী) বিচারপতির অভিশংসনের কোনো বিষয় নেই; বরং সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারপতির শাস্তির জন্য যে শব্দটি বলা আছে, তা হলো ‘অপসারণ’, ইংরেজি ভার্সনে লেখা হয়েছে ‘Remove’।
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একনজরে দেখে নেওয়া যাক, আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ওই চিঠিতে কী লিখেছেন? ১৩ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি বরাবর লেখা ওই চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেছেন, তাঁর (শামসুদ্দিন চৌধুরী) পেনশন কার্যক্রম বিষয়ে প্রধান বিচারপতি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না; বরং তাঁকে চিঠি দিয়ে বলা হয়েছে, পেন্ডিং সব মামলার রায় লেখার পরই পেনশন কার্যক্রম শুরু করা হবে। প্রধান বিচারপতির এ সিদ্ধান্তকে বৈষম্যমূলক ও বিদ্বেষপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। তাঁর দাবি, ব্যক্তিগত বিরাগের বশবর্তী হয়ে প্রধান বিচারপতি তাঁকে বিচারকাজ থেকে বঞ্চিত করে অসদাচরণ করেছেন, যা অভিশংসনযোগ্য। শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি কোনো মামলায় অনুরাগ ও বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে বিচারকাজ পরিচালনা করতে অক্ষম।
মনে রাখা দরকার, এই আবেদন যিনি জানিয়েছেন, ২০১২ সালে নবম সংসদে তাঁকে অপসারণের জন্যই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তুলেছিলেন সংসদ সদস্যরা। সুপ্রিম কোর্টসংলগ্ন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ভবন ইস্যুতে তৎকালীন স্পিকার (বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ) সংসদে একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেন হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। এমনকি স্পিকারের ওই বক্তব্যকে তিনি ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’ বলেও মন্তব্য করেন। এর পর শামসুদ্দিন চৌধুরীর কড়া সমালোচনা শুরু হয় সংসদে। সিনিয়র সংসদ সদস্যরা ওই বিচারপতির বিচারের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তোলেন।
এ বিষয়ে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ সংসদে একটি রুলিং দেন। তিনি বলেন, ‘আমার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা কোনো বিবেকমান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না, আমার সন্দেহ আছে। আমার কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন—এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।’
বিচারপতির মন্তব্যকে দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত উল্লেখ করে রুলিংয়ে তৎকালীন স্পিকার আবদুল হামিদ আরো বলেন, ‘আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।’
প্রসঙ্গত, সংবিধানে তখন বিচারকদের অপসারণের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের বিধান ছিল, যা পরবর্তীকালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। ফিরিয়ে আনা হয় বাহাত্তরের মূল সংবিধানের বিধান। অর্থাৎ এখন কোনো বিচারককে তাঁর অসদাচরণের অভিযোগে অপসারণ করতে চাইলে সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য প্রস্তাব আনতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি আদেশ দিলে ওই বিচারক অপসারিত হবেন। অর্থাৎ সংবিধানে ‘অভিশংসন’ বা ‘ইমপিচমেন্ট’ শব্দটি নেই। বলা হয়েছে সরাসরি ‘অপসারণ’।
শামসুদ্দিন চৌধুরীর ওই চিঠিতে একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হলো, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বিরোধ। কিন্তু কেন? সম্প্রতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর কথোপকথনের একটি অডিও টেপ প্রকাশ হওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিলের রায়ের আগে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা উঠলে তা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এর শুনানিতে গত ১১ আগস্ট জনকণ্ঠের আইনজীবী অডিও রেকর্ডের শ্রুতিলিখনের অংশবিশেষ তুলে ধরেন, যাতে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে টেলিফোনের অন্য প্রান্তের বিচারপতির মতপার্থক্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। এর পর বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অবসরে যাওয়ার আগে অস্বাক্ষরিত রায় নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তাঁর কয়েকটি চিঠি চালাচালির ঘটনাও গণমাধ্যমে আসে। তবে সিনিয়র আইনজীবীদের কেউ কেউ এ বিষয়ে এরই মধ্যে মন্তব্য করেছেন, প্রধান বিচারপতির অভিশংসন চেয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠি পাঠানো শোভনীয় হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী সমাজের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আদালতে ডেকে এনে তাঁদের সঙ্গে যে ধরনের আচরণ করেছেন, সেটিও শোভন ছিল না।’
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তাঁর সিনিয়র সহকর্মীর অভিশংসনের দাবি জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে যে চিঠি দিয়েছেন, সেটার মোদ্দাকথা প্রধান বিচারপতির অপসারণ। শব্দ তিনি যেটিই ব্যবহার করুন না কেন। এখন প্রশ্ন হলো, বিষয়টির কীভাবে সমাধান হবে?
এর সমাধান দুটি। রাষ্ট্রপতি চাইলে এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নাও নিতে পারেন। অর্থাৎ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী যে চিঠি দিয়েছেন, বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারে। অথবা রাষ্ট্রপতি যদি চান, বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য চিঠিটি সংসদে পাঠাতে পারেন। সংসদ যদি মনে করে, অর্থাৎ সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি প্রধান বিচারপতিকে অপসারণের বিষয়ে একমত হন এবং এ বিষয়ে প্রস্তাবে সই করেন, তাহলেই কেবল রাষ্ট্রপতি এ বিষয়ে আদেশ দিতে পারবেন। অর্থাৎ প্রধান বিচারপতিকে অপসারণ করতে হলে বিষয়টিকে অবশ্যই সংসদে পাঠাতে হবে। পুরো বিষয়টি সংসদের এখতিয়ারে চলে যাবে। এখানে রাষ্ট্রপতির এককভাবে কিছু করার ক্ষমতা নেই।
বিচারপতিদের অপসারণ বা অভিশংসনের পদ্ধতি নিয়ে সংসদ চাইলে একটি আইন করতে পারবে বলে সংবিধানে নির্দেশনা রয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখনো কোনো আইন হয়নি। সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, শিগগিরই এ বিষয়ে আইন হবে।
তাই যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের স্পিকার থাকা অবস্থায়, তাঁর সম্পর্কে ‘বিরূপ’ মন্তব্য করেছিলেন এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ সদস্যরা ওই বিচারপতির অপসারণ দাবি করেছিলেন, সেই বিচারপতির দাবি অনুযায়ী এখন রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির অভিশংসন বা অপসারণের দাবিসংবলিত এই চিঠি সংসদে পাঠাবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।