অভিমত
অযোগ্য ঢাকায় বসত করেন কারা?
আমরা টেলিভিশন খুললে কিংবা পত্রিকার পাতায় দৃষ্টি রাখলেই দেখি নেতারা সুন্দর ভাষণ বক্তৃতায় দুর্বার গতিতে দেশ এগিয়ে যাওয়ার গল্প শোনান। কিন্তু সেটা কেবল মুখে বললেই তো হবে না, প্রমাণও থাকতে হবে। নিশ্চিতই আমাদের অনেক সূচক অগ্রগামী। মাঝেমধ্যে বিদেশি সংস্থাও সে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের প্রাণভোমরা রাজধানী ঢাকা শহরকে কেন আমরা বসবাসের উপযুক্ত করতে পারি না? গেল সাত বছর ধরেই বসবাস অযোগ্যতার তালিকায় ঢাকা থাকছে ২ অথবা ৪ নম্বরে। এর মধ্যে এবারের র্যাংকিং সবচেয়ে হতাশাজনক। খারাপ পজিশনে সারা বিশ্বে আমাদের ওপরে আছে কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক শহর। সেই শহরও প্রায় সব সূচকেই আমাদের সমান। কিন্তু আমাদের জন্য লজ্জাকর সত্য হলো, প্রতিদিন বোমা পড়া সেই শহরের অবকাঠামো আমাদের চেয়ে ভালো। আমাদের সর্বনিম্ন পয়েন্ট ২৬ দশমিক ৮। আর দামেস্কের রেটিং ৩২ দশমিক ১।
অর্থনীতিবিষয়ক ব্রিটিশ সংস্থা ‘দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)’ প্রতিবারের মতো এবারও পাঁচটি বিভাগে বিশ্বের ১৪০টি শহরে বাসযোগ্যতার তুলনা করেছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষার সুবিধা এবং অবকাঠামো—এর প্রতিটি বিভাগেই তিন থেকে নয়টি করে মোট ৩০টি সূচকের ভিত্তিতে শহরের অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে। মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে ঢাকা পেয়েছে ৩৮ পয়েন্ট। গতবারের তুলনায় যা দশমিক ৭ ভাগ কম। দামেস্কের রেটিং পয়েন্ট ৩০ দশমিক ৭ এবং শীর্ষ বাসযোগ্য শহর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার পয়েন্ট ৯৯ দশমিক ১।
রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে অযোগ্যতায় বিবেচনা করা হয়েছে। সেইসঙ্গে স্বাস্থসেবা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও অবকাঠামোর নিরিখে আমরা এখন নিচের দিক দিয়ে দ্বিতীয়। সেনেগালের ডাকার, আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স, ক্যামেরুনের ডুয়ালা, লিবিয়ার ত্রিপোলি, জিম্বাবুয়ের হারারে, পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোর্সবি, পাকিস্তানের করাচি এবং নাইজেরিয়ার লাগোসও আমাদের ওপরে অবস্থান করছে।
আমরা কি আসলেই চাই আমাদের বসবাসের শহরটা, যেখানে আমরা শিশুসহ পরিবারের স্বজনদের নিয়ে বসবাস করি, সেটা শান্তিপূর্ণ হোক, বসবাসের যোগ্য হয়ে উঠুক? শুধু নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করায় তালিকায় আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে উঠে এসেছে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার। আগের র্যাংকিংয়ে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় ৩৫তম অবস্থানে থাকলেও এবার সেটি ১৬তম অবস্থানে এসেছে। জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, তালিকায় থাকা অর্ধেক শহর বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে। এবং তাদের র্যাংকিংও ভালো পজিশনে এসেছে। আমরা উন্নত বিশ্বের টোকিও, সিডনি, ওসাকা, মেলবোর্ন না হতে পারি, করাচি বা হারারের চেয়ে আমরা নিচে অবস্থান করি কীভাবে?
নাগরিক অশান্তি, সন্ত্রাস বা যুদ্ধবিগ্রহকে সূচকের সারণি নির্ধারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আমাদের দেশে হয়তো যুদ্ধবিগ্রহ নেই। কিন্তু নাগরিক শান্তি বলে কি কিছুই আর অবশিষ্ট আছে। দেশের সব শীর্ষ সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল বাণিজ্যকেন্দ্র কিংবা বিপণিবিতান ঢাকায় স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু একজন বাইরের মানুষ যখন ঢাকায় প্রবেশ করেন, তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন রাজধানীতে পা রাখবার কী দুঃসহ যন্ত্রণা। এই শহরে সুসভ্য শান্তিপূর্ণ মানুষের ব্যবহারের জন্য ভালো কোনো গণপরিবহন নেই। অকেজো যা কিছু আছে তা-ও সড়ক বিপর্যয়ে পড়ে সারাক্ষণ যানজট পাহারা দেয়। সামর্থ্যবান যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, তারাও ধুলা ও গরমের হাত থেকে বাঁচতে জ্যামে পড়ে এসির হাওয়া খেতে গিয়ে সবার জন্যই ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ বাড়িয়ে চলেন। মানুষের জরুরি প্রক্ষালনের জন্য পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা নেই, পায়ে হাঁটার ফুটপাতও নেই।
মোটের ওপর ঢাকার সাধারণ মানুষের, শিক্ষার্থীর, কর্মজীবীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বলে কিছু নেই। শুধু রাস্তায় আটকে থেকে কতটা সময় কর্মঘণ্টা নষ্ট করেন, দেশের অমূল্য তেল-গ্যাস পুড়িয়ে চলেন তার হিসাব কে রাখে? র্যাংকিংয়ের অবনমন নয় কেবল, এতটা অশান্তিতেও আমাদের এই শহরে যারা ধৈর্যের সঙ্গে রোজ দিন পার করেন, জরিপকারী সংস্থা তাদের প্রশংসায় বরং কিছু সাধুবাক্য ব্যয় করতে পারত!
বিষেষজ্ঞরা বলছেন, চাহিদামাফিক কর্মসৃজনের বিকেন্দ্রীকরণ নেই বলে জ্যামিতিক হারে ঢাকায় মানুষ বাড়ছে। জলাধার, পর্যাপ্ত সড়ক বা অক্সিজেনের আধার বৃক্ষ ও সবুজায়নের ব্যবস্থা না রেখেই তাদের জন্য অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়েই মানুষ সেসব আবাসস্থলে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। পুরান ঢাকায় শতবর্ষী যেসব বিল্ডিং রয়েছে, সেখান থেকে মানুষকে সরানো যায়নি। অতটা সক্ষম আমরা হয়ে উঠিনি। কিন্তু ন্যাচারাল ডিজাস্টার বিশারদদের মতে, ঢাকায় যদি ৫-৬ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়, তার পরিণতিতে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে, তা সামাল দেওয়া বড়ই কঠিন হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমাদের রাজনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অথবা নগর পরিকল্পনাবিদরা এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার কথা ভাবেনইনি।
ফি বছর ঢাকা শহরের হাজারো মানুষ মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় ভোগে। এখানে না আছে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, না আছে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। আবার অসুস্থ মানুষ চিকিৎসালয়ে গিয়েও এক ধরনের অসাধু বাণিজ্যিক পরিস্থিতিতে গিয়ে পড়েন। চিকিৎসা পরিষেবাটাও তাকে উচ্চমূল্যে কিনে নিতে হয়। রাষ্ট্র অর্থ ব্যয় করছে দেদার। কিন্তু সে অর্থের সুফলভোগী এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষ নন।
শুধু রাজধানী ঢাকা শহর নয়, গোটা দেশটাতেই এখন চলছে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্রান্তিকাল। অর্থের কারা প্রকোষ্ঠে অন্তরীণ আমাদের সুশিক্ষা। শুধু রাজনৈতিক কারণে বহুমাত্রিক শিক্ষাকে একই যোগ্যতায় নিয়ে এসে অনভিপ্রেত সারলীকরণ করা হচ্ছে। যে কেউ চাইলেই এখন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হোল্ডার হতে পারেন। কিন্তু পরিকল্পনাহীন সেইসব গ্র্যাজুয়েটকে আমরা কর্মমুখী শিক্ষা উপহার দিতে পারি না। যে কারণে একজন বুয়েট ইঞ্জিনিয়ারকে হতে হয় পুলিশের উপপরিদর্শক। আর একজন ডাক্তার চলে যান অ্যাডমিন ক্যাডারে। দেশে যে হারে ধর্মশিক্ষা বাড়ছে, রাষ্ট্রীয় সনদধারী হচ্ছেন, সে তুলনায় বিজ্ঞান শিক্ষার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। আপনি যদি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ না পান, গবেষক না তৈরি করতে পারেন, আপনার নাগরিক পরিষেবার উন্নততর পরিকল্পনা কারা করবেন? এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে দামেস্ক যদি আমাদের হারিয়ে দেয়, অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
মানুষের বোধ বিনির্মাণে সংস্কৃতি চর্চাটা জরুরি। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য, স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস উদযাপনেও বাঙালি একাট্টা—একমত বা স্বাধীন নয়। ঢাকা শহরে কোনো নারী বাইসাইকেল বা মোটরবাইক চালালে তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয়। বাসে উঠলে কাপুরুষেরা নিপীড়ক হয়ে ওঠে। নারী এখনো প্রকাশ্য যৌন হয়রানির মূল লক্ষ্য। ধর্মীয় অবগুণ্ঠনের দোহাই দিয়ে আমাদের পালনীয় অনুদার সংস্কৃতি মানুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করে না। এভাবে চলতে থাকলে পরমতসহিষ্ণু ও ভালোবাসার মানসিকতার এক আধুনিক বাসযোগ্য শহরের স্বপ্ন কি আমরা আর কোনোদিনই দেখতে পারব? আমরা তো সর্বক্ষেত্রে উগ্রবাদী ঘৃণার এক দূষিত রাজ্য তৈরি করে ফেলেছি। বিনয়, মহানুভবতা ও প্রেম আমাদের আর ভালো লাগে না।
আমরা সত্যি জানি না, এমন ধূলিধূসরিত, স্থবির, উত্তপ্ত ও অযোগ্য ঢাকায় কারা বসত করেন। তাদের নির্বিকারত্বের অচলায়তন কবে ভাঙবে, তাও জানা নেই। তবু আমরা আশা করি, কোনো একদিন ইউরোপের ভিয়েনা থেকে একপশলা বৃষ্টি এসে রাজধানী ঢাকা শহরকে ধুয়ে দিয়ে যাক। আমাদের আগামীর সন্তানরা জাতিগোত্র মিলেমিশে সুশান্তিতে থাক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।