বন্ধু দিবস
হে বন্ধু, প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো
এই শ্রাবণে আধোমেঘ আধোচাঁদনী পসর রাতে বর্ষাজলে ছোটে যদি বন্ধুতার নাও। সেইখানে থাকে যদি প্রাণবন্ধুর আত্মজৈবনিক আড্ডা। জলজ পুষ্পের ভেজা ঘ্রাণ বাতাসে ভেসে আসে নাসারন্ধ্রে। পাশের বাঁশবাগানের জোনাকেরা হয় যদি মিটিমিটি তারা। মাঝির ছান্দসিক বৈঠাজলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ যদি বন্ধুতা উদযাপনের আবহ সংগীত হয়। কারো হৃদয় খুঁড়ে হারানো প্রিয়ার বেদনা জাগানো যায়। কতক মৌনতা আর কতক হৈহল্লায় কেটে যায় কয়েক প্রহর। বন্ধুবেলা উদযাপনের স্মারক হয় তখনই ভরাট কণ্ঠে গেয়ে ওঠে যদি চৈতন্যবাসী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল
বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল॥
মিলনের পত্রটি পূর্ণ যে বিচ্ছেদ -বেদনায়;
অর্পিনু হাতে তার, খেদ নাই আর মোর খেদ নাই॥
বন্ধুতা এক অপার্থিব সম্পর্কের নাম। রক্তের বাঁধনে বাঁধা নয়, অন্তরের বিনে সুতোর অচ্ছেদ্য বন্ধন এটা। যার কাছ থকে কোনো কিছুর প্রাপ্যতা আশা না করেও জীবনের সর্বস্ব সমর্পণ করা যায়। বন্ধু কখনোই বন্ধুর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয় না, বরং অনুপ্রেরণা দিয়ে যায় জীবনের শেষ বেলা পর্যন্ত। ঈশ্বর পৃথিবীতে সশরীরে সেবা দেন না সত্য, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট মানুষকে ভালোবেসে একজন উপযুক্ত বন্ধু ঠিকই পাঠান। বন্ধুর কাছে কোনো অতিরঞ্জন নেই। প্রাপ্য প্রশংসায় স্বার্থবাদী উল্লম্ফন নয়, বন্ধুর যা প্রাপ্য তাই করে কোনো এক নিখাদ বন্ধু।
কবিগুরু তাই গভীর সত্য মেনেই উচ্চারণ করেন, ‘প্রেম মন্দির ও বন্ধুত্ব বাসস্থান। মন্দির হইতে যখন দেবতা চলিয়া যায় তখন সে আর বাসস্থানের কাজে লাগিতে পারে না, কিন্তু বাসস্থানে দেবতা প্রতিষ্ঠা করা যায়।’ এমন দেবতুল্য বন্ধুর জন্যই এভাবে সুরের ধ্যান করা যায় :
শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো॥
সারা পথের ক্লান্তি আমার সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মেটাব যে খুঁজে না পাই দিশা—
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমায় সেই কথা বলিয়ো॥
আমাদের কালের শিল্পী কবির সুমন বন্ধুর বিচ্ছেদে বিহ্বল হন। কত দিন দেখা না হওয়ায় বিচলিতও বোধ করেন। হঠাৎ রাস্তায় অফিসে অনেক দিনের অদেখা বন্ধুর মুখ দেখে বিস্ময়াভিভূত হতে চান। চলতি সময়ে জীবনের গল্প পাল্টে যাওয়ার স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই বন্ধুকে তিনি বলতে চান :
দলাদলির দিন গলাগলির দিন
হঠাৎ অকারণে হেসে ওঠার দিন
বন্ধু কি খবর বল
কতদিন দেখা হয়নি।
আধুনিক কালের শিল্পী তপু বন্ধুর জন্য পৃথিবী লিখে দিয়ে বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠা দেখাতে চান। পুরো পৃথিবী এক দিকে, আর আমি অন্য দিক/ সবাই বলে করছ ভুল, আর তোরা বলিস ঠিক/ তোরা ছিলি, তোরা আছিস/ জানি তোরাই থাকবি/ বন্ধু বোঝে আমাকে, বন্ধু আছে আর কী লাগে?’ আর কী চাই বন্ধুত্ব তো এমনই।
আজ আগস্টের প্রথম রোববার ‘বন্ধু দিবস’। আমরা জানি, ভালোবাসার গল্প বুনতে বন্ধু সাগরের জোয়ার-ভাটায় পূর্ণিমার তিথি লাগে না। দিবসের ভেদবিচার লাগে না। তবু একদিন সকল কাজ ভুলে বন্ধুতার জন্য আয়োজনের ডালি সাজালে মানবীয় সম্পর্কের সুন্দর আনন্দবাগিচা আরও সুশোভিতই হতে পারে। যাপিত জীবনের সকল পঙ্কিলতা ভুলে, দুঃখ-শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমরা আরেকবার সমস্বরে না হয় উচ্চারণ করলাম, শুভ বন্ধু দিবস।
বন্ধুহীন জীবন যেন এক বিগ ‘জিরো’। আমার অস্তিত্বকে পরখ করবার দায় বন্ধুরও অনেকখানি। কবিগুরু তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ ‘শূন্যে’ যেমনটা বলেন, “এক এক জন লোক আছে, তাহারা যতক্ষণ একলা থাকে ততক্ষণ কিছুই নহে, একটা শূন্য (০) মাত্র, কিন্তু একের সহিত যখনি যুক্ত হয় তখনি দশ (১০) হইয়া পড়ে। একটা আশ্রয় পাইলে তাহারা কি না করিতে পারে! সংসারে শত সহস্র ‘শূন্য' আছে, বেচারীদের সকলেই উপেক্ষা করিয়া থাকে—তাহার একমাত্র কারণ সংসারে আসিয়া তাহারা উপযুক্ত ‘এক' পাইল না, কাজেই তাহাদের অস্তিত্ব না থাকার মধ্যেই হইল।”
বন্ধুত্বের স্বাধীনতা প্রেমেরও অধিক। ভালোবাসা হতে হয় নিখুঁত নিটোল ছকেবাঁধা পাথরবৎ শক্ত। অথচ বন্ধুত্ব সেখানে পুরাই উড়াধুরা। ভালোবাসা পুরাই ফরমাল। বন্ধুত্ব ফরমালিটির ধার ধারে না। ভালোবাসা ভেঙে গেলে তা বাতিল। কিন্তু সাধনায় নিষ্ঠ বন্ধুত্বের কোনো ফাটল নেই। ভালোবাসা বা প্রেম যেন স্বর্গীয়। আর বন্ধুত্ব পুরাই জাগতিক। রবিঠাকুর তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায়’ এই বিষয়টি যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন, ‘বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালবাসা পোষাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল। কিন্তু ভালবাসার পোষাক একটু ছেঁড়া থাকিবে না, ময়লা হইবে না, পরিপাটি হইবে। বন্ধুত্ব নাড়াচাড়া টানাছেঁড়া তোলাপাড়া সয়, কিন্তু ভালবাসা তাহা সয় না। আমাদের ভালবাসার পাত্র হীন প্রমোদে লিপ্ত হইলে আমাদের প্রাণে বাজে, কিন্তু বন্ধুর সম্বন্ধে তাহা খাটে না; এমন-কি, আমরা যখন বিলাসপ্রমোদে মত্ত হইয়াছি তখন আমরা চাই যে, আমাদের বন্ধুও তাহাতে যোগ দিক! প্রেমের পাত্র আমাদের সৌন্দর্যের আদর্শ হইয়া থাক এই আমাদের ইচ্ছা—আর, বন্ধু আমাদেরই মত দোষে গুণে জড়িত মর্ত্ত্যের মানুষ হইয়া থাক এই আমাদের আবশ্যক।’
কিন্তু নিবন্ধে উল্লেখিত এমন বন্ধু কোথায় পাব আমরা? দৃষ্টি প্রসারিত করলে বন্ধুর অভাব হয় না। হাত বাড়ালে বন্ধুরা ফিরিয়েও দেয় না। আমরা খেয়াল করলেই দেখব গেল সপ্তাহজুড়ে আমাদের কোমলমতি বাছারা সড়ক চলাচলে নিরাপত্তা চেয়ে যে নজিরবিহীন আন্দোলন করে যাচ্ছে তার উদাহরণ পুরো পৃথিবীতেই বিরল। ইশকুল-কলেজে পড়ুয়া শিশু-কিশোররা মহাসড়কে মন্ত্রী, বিচারপতি, পুলিশের ডিআইজি কিংবা গণমাধ্যমের গাড়ি তল্লাশি করে দেখিয়ে দিয়েছে যাদের আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করবার কথা এবং যাদের তথ্যের অধিকার সমুন্নত রেখে রাষ্ট্রের যথার্থ চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে ওঠবার কথা তাদের গাড়িতেই বৈধ কাগজপত্র থাকে না। রাষ্ট্রের নিয়ম, নীতি ও আদর্শের ঝান্ডাদারি যারা তাদের কাছেই বৈধতার সনদ নেই। অথচ তারা সাধুসন্তুর মুখোশ পরে খোলা ময়দানে ঘুরে বেড়ান। তাদের চিনিয়ে দিল কারা? আমাদের সবার ভালো হয়ে যাওয়ার মন্ত্র শেখাল কারা? সে তো আমাদের ওই শিশু সন্তানেরাই। তারা বাংলাদেশের কী হয়? নিশ্চিতই বন্ধু।
আমরা আমাদের সুবর্ণ পুত্রকন্যাদের নাম দিতে পারি ‘দেশবন্ধু’। আমাদের একটাই চাওয়া বাংলাদেশকে তার আপন আয়নায় প্রতিবিম্বিত করবার কারিগর আমাদের দেশবন্ধুদের সম্মানটুকু যেন আমরা রক্ষা করি। এমন মহত্তম শিশুতোষ ভালোবাসার সাথে যেন হার্ডলাইনের বেসুরো রাজনীতিকে গুলিয়ে না ফেলি। সবার প্রাণে ওদের পবিত্র বন্ধুতার পরশখানি যেন রাখি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।