অভিমত
ঘুরে দাঁড়াও বাংলাদেশ, শিশুরা পথ দেখাচ্ছে
যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ
যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।
এমন সত্যাদর্শী স্লোগানসমেত প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে রোদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে আমাদের মানবিক বোধসম্পন্ন সন্তানেরা। যারা রাষ্ট্রীয়বাহিনীর ভয়াল বাঁধাতেও নিরেট পাথরের মতো নিশ্চল নির্ভয়। অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধ্বে রুখে দাঁড়ানোটা তাই ওদেরই মানায়।
সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনে ঢেউ তোলা পৃথিবীর সুন্দরতম কিছু দৃশ্য প্রাণভরে দেখলাম আমরা। একটিতে যানবাহন ও চালকের বৈধ কাগজপত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে, অপরটিতে বেপরোয়া রিকশাওয়ালাদের ডিসিপ্লিন ঠিক রাখতে দেখা যাচ্ছে! কোনো ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে রীতিমতো বৃষ্টিতে ভিজে সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিকিং করা হচ্ছে। এসব কাজই করছে আমাদের ছেলেমেয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশে এমন অভাবনীয়, চোখ জুড়ানো ও হৃদয়হরণ করা দৃশ্য ইতিপূর্বে আর কেউ দেখেছে কি না জানা নেই। দৃষ্টি আর্দ্র করে দেওয়া এমনতর নায়কেরাই আসলে প্রত্যাশার বাংলাদেশ।
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সরকার রোজ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে। অনেক কড়ি ও পদপদবীর বিনিময়ে বহু বড় ক্যাডার, আমলা বা মন্ত্রীরা এর পেছনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মূল্যবান সময় পাস করে। কিন্তু এত দিন তারা কিচ্ছুটি করে দেখাতে পারেনি। রাজধানী ও এর আশপাশে ভয়াবহ যানজট, পরিবহন সন্ত্রাসীদের নৈরাজ্য এবং প্রাণহানির ঘটনা লেগেই থাকছে।
অথচ কী এক জাদুমন্ত্র বলে এক লহমায় ঢাকাকে সোজা করে দিয়েছে একদম বাচ্চা ছেলেমেয়েরা! কারণ এরা তাদের হারিয়ে ফেলা করিম বা মিমের মতো সতীর্থ, বন্ধু ও স্বজনের ভার আর বইতে পারছে না। এরা মরচে ধরা, ব্যাকডেটেড ও চিরাচরিত রাষ্ট্রীয় সিস্টেমে অনাস্থা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র অনেক আগেই ডেট এক্সপায়ার করে গেছে।
এই শিশুরাই যুক্তি ও দৃঢ়তার সাথে বলতে পারছে, ‘বিবেক তবে কবে ফিরবে?’, ‘বিচার শুধু মুখে শুনেছি এখন বাস্তবে দেখতে চাই’, ‘উই ডোন্ট ওয়ান্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ উই ওয়ান্ট সেফ বাংলাদেশ’, ‘ফোরজি স্পিড নেটওয়ার্ক নয় ফোরজি স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’, ‘পুলিশ আঙ্কেল আপনার চা সিগারেটের টাকা আমি আমার টিফিনের টাকা দিয়ে দিচ্ছি তাও আপনি এসব গাড়ি চালাতে দিয়েন না’, ‘জীবন নিয়ে খেলা বন্ধ চাই রাজপথে নিরাপত্তা চাই’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’!
তারপরও এই শিশু, কিশোর ও যুবাদের অবজ্ঞা করবেন? কেন করবেন? কাদের জন্য করবেন? যারা আপনাদের খামখেয়ালিতে মানুষের করুণ মৃত্যুর শোকবিহ্বলতায়ও হাসে, যারা গায়ে শৃঙ্খলাবাহিনীর পবিত্র পোশাক পরে রাষ্ট্রীয় নাগরিককে কলার ধরে শাসায়, পিটিয়ে রক্তাক্ত করে, যারা অর্থের কাছে সততা, কর্তব্য, ন্যায়নিষ্ঠা, শ্রেয়বোধ, বিবেক, মায়া, মমতা ও ভালোবাসা সব বিক্রি করে দিয়েছে সেই বেপথো মানুষদের জন্য?
না, প্রিয় রাষ্ট্র আপনি তা পারেন না! এই শিশুদেরকে শাসানোর আগে ভয় দেখানোর আগে নিজেরা লজ্জিত হোন, নিজেদের শোধরানোর প্রয়াস নিন। শিশুদের ঘরে ফেরানোর আগে তাদের সব দাবি মেনে নিন। শিশুমনের পুতঃপবিত্র ভাবনার সাথে নিজেদের চিন্তা একীভূত করুন। এতে আপনারা গণমানুষের আদর্শিক ট্র্যাকে থাকবেন। আদারওয়াইজ ট্র্যাকচ্যুত হতে কতক্ষণ? দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল বিদ্রোহ করা ছাড়া মানুষের উপায় থাকে না। আর আঠার বছর বয়সের নিচে শিশুবিদ্রোহ? তাতো স্বচক্ষেই দেখতে পাচ্ছেন! কতটা বাধ্য হলে ইশকুল কলেজ বন্ধ করে দিতে হয়- আমরা এর মর্ম বুঝি মিস্টার সরকার!
আমরাও চাই শিশুরা ঘরে ফিরুক, মায়ের কোল সুখ-শান্তিতে ভরিয়ে রাখুক। রাস্তায় ওরা নিরাপদে হাঁটার অধিকার পাক। যাওয়ার আগে নিভে যাওয়া প্রায় নিশ্চিহ্ন যে মশালে ওরা আগুন জ্বালিয়ে গেল সেই আলোকবর্তিকার সম্মান আপনারা যদি না রাখতে পারেন তবে কীসের মানুষ আপনারা? মিলিয়ন ডলার খরচ করে মহান সংসদে যে আইন আপনারা 'হ্যাঁ জয়যুক্ত' হলো বলে পাস করেন তাতো ইমপ্লিমেন্ট করতে পারেন না। তাহলে ওসব নামকাওয়াস্তে আইনের আমাদের কী দরকার? তারচে বরং আমাদের সুবর্ণপুত্র ও কন্যা যারা মানবতার টানে অন্যায় ও অযাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে তাদের কাছ আইনের 'ছবক' নিন। এই শিশুদেরকে মাথায় তুলে রাখুন। সত্য একমাত্র ওরাই বলছে, সুন্দরের সাধনাও ওরাই করছে। আর কেউ নয়। দয়া করে আপনাদের বর্বরীয়, স্বার্থগন্ধযুক্ত ও লোভাতুর বাজে সিস্টেমে ওদের অভিযোজিত হতে না দিয়ে ওদের দাবিদাওয়া মেনে নিন। ওদের মন পড়ুন। শিশুবান্ধব ও মানবিক সমাজ গড়ুন।
প্রতিবাদী শিশুদের সকল দাবির প্রতি একাত্ম না হওয়াটা বড় পাপ ভাবি। ওদের একটা চাওয়া যদি এই রাষ্ট্র পূরণ করতে পারে বাকিসব আপনিই প্রাপ্যতার সিঁড়িতে ওঠে যাবে। শিশুরা চাইছে, আমাদের ভোটে যারা নির্বাচিত তাদের সপ্তাহে তিনদিন গণপরিবহনে ভ্রমণ করতে হবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও দেশের নাম্বার ওয়ান জনপ্রতিনিধি। মন্ত্রী, এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যানরা যখন পাবলিক বাসে ওঠবেন তখন তাদের সহযোগী আমলারাও তা করতে বাধ্য থাকবেন। বিআরটিএর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যখন নিজে ভুক্তভোগী হয়ে দেখবেন যে, অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কেমন অযোগ্য ও প্রশিক্ষণবিহীন চালককে তারা লাইসেন্স দিয়েছেন, কেমন লক্করঝক্কর ব্রেকফেল গাড়িকে তারা রুট পারমিট দিয়েছেন এবং এভাবে টোটাল পরিবহন সেক্টরটাকেই এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন, তখন বুঝবেন নিজের সাথে নিজেই কত বড় অন্যায় করে দেশটাকে ডুবিয়ে দিয়েছেন।
সেই ডুবে যাওয়া প্রাণের বাংলাদেশটার এবার সময় হয়েছে নিজেকে জাগিয়ে তুলে ঘুরে দাঁড়াবার। দেশমাতার নিজেকে সঠিক লাইনে ফেরাবার দিনে, অন্ধকার অমানিশা কাটিয়ে আলোয় ফিরবার দিনে, আমাদের প্রাণোচ্ছ্বল শিশুরাই হবে সত্যিকারের সারথি। আমরা তাদের সার্থক অনুবর্তী মাত্র। এই শিশুদের জয় অনিবার্য। দ্রোহী ও প্রেমময় শিশুরা সবার প্রাণে যে অধিকারবোধের সুরের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, সে আগুন ছড়িয়ে গেছে সবখানে। এখন আমরা আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়েই রাবীন্দ্রিক সুর গাইতেই পারি :
নিশীথের বুকের মাঝে এই যে অমল
উঠল ফুটে স্বর্ণকমল
আগুনের কী গুণ আছে কে জানে!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন