সিটি নির্বাচন
নিজেদের যাচাই করে নিল দলগুলো
তিন সিটির নির্বাচনের ফলাফল একটু গোলমেলে ঠেকতে পারে। কারণ, যে সিলেটে বিএনপির দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং জোটের শরিক জামায়াতের সঙ্গে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হিসেবে দেখা হচ্ছিল, সেখানে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী দ্বিতীয়বারের মতো নগরপিতা নির্বাচিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। জামায়াতের ১১ হাজার ভোট যোগ করলে ব্যবধানটি আরো বেশি হতে পারত। অথচ বিএনপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বরিশাল ও রাজশাহীতে বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছেন দলটির মেয়র প্রার্থীরা।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নীলনকশার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পুকুরচুরি বলেছে বিএনপি। আর উন্নয়ন এবং জোটের একতার ফলাফল হিসেবে দেখছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচন চলাকালে বিএনপির অভিযোগের ধারায় এবার আওয়ামী লীগও দুটি কেন্দ্র দখলের অভিযোগ করেছে বিএনপির বিরুদ্ধে, যা কিছু নতুনত্ব হিসেবে দেখা যেতে পারে। সিলেটের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত চেয়ে আবেদনও করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।
দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে? অবশ্য এই তিন সিটির নির্বাচন নানমুখী বিশ্লেষণের দাবি রাখে। যে কয়েকটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত রাখা হয়েছে কিংবা গণমাধ্যমে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে, শুধু কি সেই কটি কেন্দ্রেই অনিয়ম হয়েছে? অবশ্য সব ক্ষেত্রেই মেয়র প্রার্থীদের ভোট নিয়ে বিশৃঙ্খলা হয়েছে তেমনটি নয়। আর এই অনিয়মের অভিযোগ করে কি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়?
তিন সিটিতে মোট ভোটার ছিল প্রায় আট লাখ ৮২ হাজার। ৩৯৫টি ভোট কেন্দ্রের ২৯১৫টি কক্ষে ভোট গ্রহণ হয়। সব কেন্দ্রে বা কক্ষে কি গণমাধ্যম, নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিংবা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক টিম পৌঁছতে পেরেছে? তবে অবশ্যই সব কেন্দ্রেই ছিলেন নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলীয় নেতাকর্মীরাও।
রাজশাহীতে বড় ব্যবধানে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন জয়লাভ করেছেন। প্রার্থী হিসেবে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলও শক্ত প্রার্থী ছিলেন। সেখানে অনিয়মের অভিযোগটি অনুসন্ধান পর্যায়ে রেখে দিলে বলতে হয় আগের মেয়াদে উন্নয়নকাজ এবং দূষণমুক্ত নগরী গড়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন খায়রুজ্জামান লিটন। গত পাঁচ বছরে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বেশির ভাগ সময় হয় কারাগারে কাটিয়েছেন, নয়তো তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সময় নাগরিকরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পায়নি। এটি ভোটে একটি বড় ফ্যক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
অন্যদিকে, বরিশালে বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার নির্বাচনের মাঝপথে সরে যান, এর যৌক্তিকতা নিয়ে তখন প্রশ্ন ওঠে। সমালোচনা শুরু হয় ভোট বর্জনের ঘোষণার পর থেকেই। ভোট গ্রহণ শুরুর চার ঘণ্টা মধ্যে বিএনপির প্রার্থীর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও বরিশালে ১৫টি কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। তবে একজন নারী মেয়র প্রার্থী বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল—বাসদের ডাক্তার মনীষা চক্রবর্ত্তী যেভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন, তাতেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়।
বিএনপিরও এই একজন মনীষার কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। একজন নারী, যদিও মাত্র দুই হাজারের কম ভোট পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর যে লড়াকু ও তেজি মনোভাব দেখাল তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কেন্দ্রে কেন্দ্রে এজেন্ট না থাকাও বিএনপির জন্য বেমানান। ভোটকেন্দ্র দখল এবং এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ঢালাওভাবে না করে নির্দিষ্টভাবে কোন কোন কেন্দ্রে হয়েছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে রিটার্নিং অফিসার কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে পারত। যেটা মনীষা করতে পেরেছেন।
এবার আসতে চাই রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির শেষ সময়ে এসে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং মহাজোটের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়াটা দলটির জন্য কিংবা জাতীয় রাজনীতির জন্য কতটা ইতিবাচক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে।
অবশ্য বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ২০১৪ সালের পর থেকেই একটু একটু বাড়ছিল, তা আগে থেকেই স্পষ্ট ছিল। তবে সিলেটে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়া, রাজশাহী ও বরিশালে বিএনপির প্রার্থীর পক্ষে মাঠে না নামাটা ছিল দলটির অনেকটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত। কারণ, নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলীয় প্রতীকে জামায়াত আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, সে ক্ষেত্রে তাদের যে ভোটব্যাংক আছে এই মেসেজটি বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে দিতে চেয়েছে নিজেদের গুরুত্ব তৈরির জন্য। যাতে করে আগামী নির্বাচনে জামায়াতকে ফ্যাক্টর ভাবা হয়। সেইসঙ্গে মামলা গ্রেপ্তার থেকে নিজেদের নেতাকর্মীদের রক্ষা করার জন্য সরকারের চোখে ইতিবাচক থাকা।
তবে নির্বাচন নিয়ে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, খুলনা ও গাজীপুর থেকে শুরু করে এই তিন সিটির নির্বাচন আগামী নির্বাচনের জন্য রসদ জুগিয়েছে। কারণ এখানে প্রধান রাজনৈতিক দল বা জোটগুলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের সাংগঠনিক অবস্থান, শক্তিমত্তা, কৌশল যাচাই করার সুযোগ পেয়েছে। বিএনপি নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্ট থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের দুর্বলতাগুলো তুলে ধরতে পেরেছে।
জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সামনের দিনগুলোয় জোট-মহাজোটের অনেক খেলা অপেক্ষা করছে। বড় নেতাদের ছোট ছোট দলও নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে জোট গঠন করছে। তবে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে আলোচনার ভিত্তিতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাবে রাজনৈতিক দলগুলো, এটাই এখন একমাত্র কামনা।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।