গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি
মানুষের ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে
গণমানুষের যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে সরকার। কয়েক দিন ধরেই ভাড়া নিয়ে গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছিল। কারণ গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যোগাযোগমন্ত্রী সে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ১০ তারিখের আগে কোনো ভাড়া বৃদ্ধি নয় (১ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ কথা বলেন)। ১০ তারিখে এসে তিনি নিজেই আবার গণপরিবহনে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দিলেন। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ১০ পয়সা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি এক টাকা ৬০ পয়সার জায়গায় এখন দিতে হবে এক টাকা ৭০ পয়সা। পয়সার হিসাব এখন আর বাংলাদেশে হয় না। কেউ যদি দুই কিলোমিটার যায় তার ভাড়া আসবে তিন টাকা ৪০ পয়সা। যেহেতু পয়সা নেই তাই তাকে দিতে হবে চার টাকা। তার মানে কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১০ পয়সা বাড়লেও যাত্রীদের গুনতে হবে ৩০ পয়সা। আর আগে দুই কিলোমিটারে আসত তিন টাকা ২০ পয়সা। ফলে তিন টাকা দিলেও চলত। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝারি দূরত্বেও কিংবা বিশেষ কাজে ব্যবহৃত বাহন সিএনজি অটোরিকশার ভাড়া প্রথম দুই কিলোমিটারে ২৫ থেকে বেড়ে ৪০ টাকা হয়েছে। পরবর্তী প্রতি কিলোমিটারে সাত টাকা ৬৪ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ ভাড়া বেড়ে গেছে আগের তুলনায় দেড়গুণেরও বেশি। শুধু যে যাত্রীর ভোগান্তি বেড়েছে তা নয়। যে গরিব চালকরা ভাড়ায় অটোরিকশা চালান তাদের মালিকের জমাও হয়েছে ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা। একদিকে তাদের বর্ধিত মূল্যে গ্যাস কিনতে হবে অন্যদিকে মালিককে জমা দিতে হবে আগের চেয়ে দেড়গুণ বেশি টাকা।
খোলা চোখে দেখলে মনে হয় ভাড়া বৃদ্ধির একমাত্র কারণ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি। আসলেই কি ব্যাপারটা তাই। শুধু গ্যাস-বিদ্যুৎ কিংবা গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি নয়, এখন আরো অনেক কিছুর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাবে। এবং এসব বাড়াবাড়ির কারণ হিসেবে কিছু ঠুনকো অজুহাতকে উপস্থাপন করা হবে। তবে ভেতরকার কারণ থাকবে একটাই; সেটা হলো নতুন পে-স্কেল। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরের মতো দেখে আসছে যতবারই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বেড়েছে ততবারই হঠাৎ করে সব কিছুর দাম হু হু করে বেড়ে গেছে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, যখনই সরকার সব কিছুর মূল্য ব্যাপক হারে বাড়ানোর চিন্তা করেছে, তখনই সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করেছে। সব সরকারই এর আগে দাম বাড়ানোর জন্য সরকার নানা ধরনের আয়োজন করে থাকে। যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরো অনেক কিছুর মূল্য বেড়ে যাওয়া। স্বভাবতই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে পণ্যের দামও বেড়ে যাবে। গ্যাসভিত্তিক যাতায়াত ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেটার প্রভাব পড়বে দ্রব্যমূল্যে। এভাবে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত পণ্যগুলোর দাম বেড়ে যাবে। মাত্র সাড়ে সাড়ে ৪ শতাংশ পে-স্কেলের সুবিধাভোগীরা হয়তো এটাকে সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু গলায় ফাঁস পড়বে বাদবাকি পৌনে সাড়ে ৯৫ শতাংশ আমজনতার।
বলছিলাম গণপরিবহনের কথা। পৃথিবীর সব উন্নত দেশে গণপরিবহনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। ধনী দেশের লোকজন গণপরিবহনেই যাতায়াত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে বেশি। অন্তত আমাদের দেশের মতো কিছু টাকা হলেই প্রাইভেট গাড়ি কিনে বসে না। ফলে তাদের সড়কগুলোতে প্রাইভেট গাড়ির আধিক্য সৃষ্ট জ্যামের দৃষ্টান্ত কম। নতুন পে-স্কেল একদিকে টাকা হলেই ব্যক্তিগত গাড়ি কিনে ফেলার বাতিকগ্রস্তদের আরো গাড়ি কেনার সুযোগ করে দিয়েছে, অপরদিকে রাস্তায় নিত্য এর ভুক্তভোগী যাঁরা, তাঁদের নাগরিক জীবনকে আরো জটিল করেছে। পে-স্কেলের বিরোধিতা করছি না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন থাকতে পারে। কিন্তু গণমানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা কেন? গণমানুষকে বারংবার গণভোগান্তিতে ফেলার কারণ কী? এই গণভোগান্তির শেষ কোথায়। এটি এখন নতুন করে ভেবে দেখার বিষয় ।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।