পায়েল হত্যাকাণ্ড
বিবেক ও মনুষ্যত্বের বিস্ময়কর নিমজ্জন
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহনকর্মীরা কতটা নির্দয় হতে পারে পায়েল হত্যাকাণ্ড তার সর্বশেষ শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। হানিফ এন্টারপ্রাইজের নিজেদের বাসের যাত্রী তাদেরই ভুলে দুর্ঘটনায় পড়লে সেই দায় ঢাকতে মারাত্মক আহত যাত্রীকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়ে খুন করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশের পরিবহন সংশ্লিষ্ট কর্মী, মালিক, নীতিনির্ধারক, আমলা বা মন্ত্রীরা লজ্জিত না হলেও মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধ নিশ্চিতই মুখ লুকিয়েছে। এটা আমরা কী করে ভাবতে পারি যে, একজন তাজা তরুণ প্রাণকে মায়ের বুক খালি করে দিয়ে স্রোতিস্বীনি নদীতে ফেলে দিয়ে খুন করে অপরাধ ঢাকা দেয়া যায়। রাষ্ট্রের কানুন, শ্রেয়বোধ, নৈতিকতা আমাদেরকে তাহলে কী শিক্ষা দিচ্ছে? দেশের মানুষ বিচিত্র উপায়ে মানুষ খুন করে সেই দুর্মর অপরাধ থেকে পার পাওয়ার বোধ-বিবেচনা পায় কোথা থেকে? আমাদের শাসন ব্যবস্থায় আইনের প্রয়োগ কি তবে এমনই নড়বড়ে?
ডেটলাইন ২১ জুলাই শনিবার রাত। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর এলাকায় ‘টয়লেট ব্যবহার’ করতে থেমে থাকা হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বাস থেকে নেমে যান চট্টগ্রামের হালিশহরের বাসিন্দা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান (পায়েল)। এর মধ্যেই যানজট কিছুটা ছাড়লে বাস এগোতে থাকে। প্রক্ষালন শেষে সাইদুর দৌড়ে এসে বাসে উঠতে গিয়ে নাকেমুখে আঘাত পান। রক্ত বের হতে থাকে। আহত যাত্রীকে চিকিৎসা দেওয়ার বদলে বাসটির চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারী মিলে একটি সেতু থেকে নদীতে ফেলে দেন। সোমবার গজারিয়ার ভবের চরে নদী থেকে পায়েলের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। দুর্ঘটনার দায় এড়াতে বাসকর্মীরা এমন কাজ করেন বলে বাসটির সুপারভাইজার মো. জনি গত বুধবার মুন্সীগঞ্জের আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।
কী অবিশ্বাস্য খবর এটা। মানুষ দুর্বিপাকে পড়লে অপর মানুষ তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেন। মানবিকতা, নৈতিকতা এবং ধর্মজ্ঞান আমাদের এই শিক্ষায় দেয়। সেখানে আমাদের পরিবহণ সেক্টরের দুর্বৃত্তরা বিপদগ্রস্ত মানুষটিকে পৃথিবী ছাড়া করে দিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারেও নরক নামিয়ে দেন। কী অসম্ভব বিবেকহীন ও নির্বিকার চিত্তকে আমরা করায়ত্ত করেছি যে, মানুষের জন্য ভালোবাসা ও মমতায় আর আমাদের অন্তর কাঁদে না। এত পাষাণ, এত হিংস্র কী করে হয়ে ওঠলাম আমরা?
মানুষ তার নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্য গন্তব্যে যায়। আর এই যাওয়া-আসাতে জল-স্থল বা আকাশপথই তাদের ভরসা। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় সড়ক পথ হলো যোগাযোগের বৃহত্তর জায়গা। অথচ অতি প্রয়োজনীয় ও নিত্য ব্যবহার্য সড়কপথই হলো ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খল। মন্ত্রীর ভাষায় বিদ্যাবুদ্ধি বা স্বাক্ষর জ্ঞান নয় চর্মচক্ষে ছাগল ও গরু দেখতে পেলেই নাকি একজন পরিবহণকর্মী ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করে। এমন চালকের সহকারীদের নিশ্চয় চোখে না দেখলেও চলে। আর মগজ কিংবা হৃদয় বলে কিছু থাকার তো দরকারই নেই।
দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ সড়কপথে চলতে গিয়ে পরিবহণকর্মীদের কাছে নাজেহাল হয়, তার নজির অন্য কিছুর সাথেই তুল্যমূল্যে বিচার্য হবে না। বিশেষ করে সন্তান সম্ভবা নারী, শিশু, অসুস্থ্য ও বয়োবৃদ্ধরা যে পরিমাণ দুর্ভোগ পোহায় তা অবর্ণনীয়।
পায়েলের মতো লম্বা পথের রাত-বিরাত কিংবা দিবাভাগের যাত্রীরা জরুরি শরীরবৃত্তীয় প্রয়োজনে গাড়ি থেকে নামবে সেই সুযোগটুকু গাড়িওয়ালারা রাখে না। এমন পরিস্থিতিতে একজন নারী, অসুস্থ, শিশু বা বৃদ্ধের কী অবস্থা হয় আমরা কি কখনো ভাবি? সরকারকে সড়কগুলোতে ফোরলেন, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, পদ্মাসেতু নামের বহুবিধ উন্নয়নের জোয়ার দেখানোর আগে মানুষের নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে হবে। চাহিবামাত্র সহনীয় সময়ের মধ্যে সড়কের পাশে কেন পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করা হবে না এবং সেসব জায়গায় বাধ্যতামূলক গাড়ি থামানোর ব্যবস্থা রাখা হবে না? সড়কে খরচ তো কম করা হচ্ছে না।
সামনে ঈদ আসছে। রাজধানী থেকে দূরের পথে যারা ঈদ করতে গিয়ে স্বজনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করবে তারা পড়ে বড় বিড়ম্বনায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক কিংবা পাটুরিয়া ফেরিঘাটের দুই পাশে মাইলের পর মাইল অসহনীয় যানজট দুর্ভোগের কথা মনে হলে কারোরই ঐ পথ মাড়ানোর কথা না। কিন্তু মানুষ শত দুর্ভোগ সয়েও তার শেকড়ের কাছে, মায়ের কাছে যেতে চায়। মানুষ যখন যানজটে বসে থাকে রাস্তার পাশে টয়লেটের অভাবে তারা রীতিমতো প্রাতঃকৃত্যের নরকভোগ করে থাকে। গলা শুকিয়ে গেলে এক গ্লাস জলের হদিসও পায় না। রাস্তায় আপনারা হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফেলেন, সেখান থেকে সামান্য টাকা বাঁচিয়ে টয়লেট ও পানীয় জলের ব্যবস্থা কি রাখা যায় না? নিশ্চিতই যায়। পরিকল্পনা এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা ও মায়ামমতা থাকলে নিশ্চিতই মানবসেবার নজির স্থাপন করা যায়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবার মতো করিৎকর্মা মানুষটি আমরা কোথায় পাব?
সড়কপথে আরেক যন্ত্রণার নাম নারীর সম্ভ্রমহানি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, গণপরিবহনে যাতায়াতকালে ৯৪ ভাগ নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা নারীরা হয়রানির সম্মুখীন হয় বেশি। এই পুরুষের অন্যতম একটি অংশ যে পরিবহণকর্মী তার উদাহরণও আছে ভুরিভুরি। দেশে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না হওয়া, বাসে অতিরিক্ত ভিড় থাকা, যানবাহনে তদারকির অভাব এসব নানা কারণে এমন পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবেই ঘটে চলেছে। গত বছর আগস্টে রূপা নামের এক যাত্রী চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বগুড়া থেকে টাঙ্গাইলের মধুপুরে আসছিলেন। বাসের অন্য সব যাত্রী আগের গন্তব্যে নেমে গেলে ছোঁয়া পরিবহনের পাঁচ কর্মী তাঁকে প্রথমে ধর্ষণ করে। পরে সেই অপরাধ ঢাকতে তারা রূপাকে হত্যা করে। সেই ঘটনায় অবশ্য অপরাধীদের সাজা হয়েছে।
আমরা চাই পরিবহণ সেক্টর একটি যুগোপযোগী নিয়তান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে চলুক। পায়েল বা রূপার খুনিদের পাকড়াও করে দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হোক। আমরা অবশ্যই পরিবহনকর্মীদের দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব। কণ্ঠ সরব করব। তবে তার আগে আমাদের কিছু দাবির দিকে সড়ক সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
যানবাহনের চালক, সুপারভাইজার কিংবা তাদের সহকারীদের জন্য আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। একাডেমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সনদ প্রাপ্যতার ভিত্তিতে কাজ করবার সুযোগ নিশ্চিত করা হোক। এসব প্রশিক্ষণের একটি বড় অংশজুড়ে সমাজের বিশিষ্টজনদের দিয়ে মোটিভেশনাল ক্লাস রাখা হোক। সেখানে ধর্ম-গোত্র-বর্ণের ঊর্ধ্বে ওঠে নারী-পুরুষকে সমমর্যাদায় মূল্যায়নের মাধ্যমে কীভাবে সেবার মানসিকতায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও মমতা প্রদর্শন করা যায় তা শেখানো হোক। ঈশ্বর মানুষের জন্যই অপর মানুষকে সৃজন করে পৃথিবীকে সবার সুন্দর সহাবস্থানের বাগান করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন -ধর্মীয় আচারনিষ্ঠা চর্চার মাধ্যমে এমনটা শেখানো হোক। ভালো হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত না করে কারো কাছ থেকে ভালোত্ব পাওয়ার আশা করা বাতুলতামাত্র।
‘মানুষ কে’ কবিতায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত চমৎকারভাবে উচ্চারণ করেছেন :
কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর।
ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তায় যে মানুষ মগ্ন থাকে সে কখনো প্রকৃত মানুষ নয়। প্রকৃত মানুষ সেই যে ব্যক্তি স্বার্থের চেয়ে পরের চিন্তাকে বড় করে দেখে। পরের স্বার্থের কথা ভেবে পরের জন্য যে হৃদয়ে ভালোবাসা সঞ্চার করতে পারে সে-ই তো মানুষ। যতটা অনুধাবন করি আমাদের পরিবহনকর্মী কিংবা স্বার্থান্ধ অন্য পেশাজীবীরাও এমন কথা লোকমুখে হলেও শোনে থাকবার কথা। কিন্তু এই ডিজিটাল যুগে পুরাণকথা, নীতিবিদ্যা কিংবা সাহিত্য সম্ভারে এখন আর মানুষ বোধ খোঁজে না। তার দরকার যেনতেন উপায়ে টাকা উপার্জন এবং আত্মস্বার্থ সংরক্ষণ। এমন মানুষ দিয়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে সভ্য বিশ্বসমাজে মুখ দেখাব কী করে? সত্য ও সুন্দরের সাধনার সময় কি এখনো হবে না আমাদের? পায়েলের মায়ের মতো আর কারো কান্নার শোকে ভারি না হোক বাংলার বাতাস। মানুষের মনুষ্যত্ব জাগুক।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন