অভিমত
ভালো ফলধারী শিক্ষার্থীদের যেসব শঙ্কা!
মূলত প্রত্যাশিত ফলের মধ্য দিয়েই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত স্বপ্নের যাত্রা শুরু। সাধারণত মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক ফলকে উচ্চশিক্ষার প্ল্যাটফর্ম কিংবা প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্প্রতি উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়েছে। এবার প্রশ্ন ফাঁসের কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিধায় এই ফলের দিকে সবার আলাদা দৃষ্টি নিবন্ধিত রয়েছে। এবার আটটি সাধারণ বোর্ড, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলে গড় পাসের হার ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। গত বছর পাসের হার ছিল ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। অর্থাৎ এবার গড় পাসের হার ২ দশমিক ২৭ শতাংশ কমেছে এবং ৫৭ হাজার ৯০ জন কম পাস করেছে।
গত বছরের তুলনায় এ বছর ফল কিছুটা খারাপ হওয়ায় এ নিয়ে পর্যালোচনার পরিমাণ বেড়েছে। অবশ্য পাসের হার কমে যাওয়ার প্রবণতাকে অনেকেই নেতিবাচকভাবে দেখছে আবার অনেকেই ইতিবাচকভাবে। কয়েক বছর ধরে যেসব কারণে পাসের হার কমছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নতুন পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়ন, এক বা একাধিক বোর্ডের ফল বিপর্যয়, কয়েকটি বোর্ডের ইংরেজিতে পাসের হার কমে যাওয়া, এমসিকিউ অংশে অনেক শিক্ষার্থীর পাস করতে না পারা ইত্যাদি। তবে দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষার্থী ও ভালো ফল তৈরির ওপরই বেশি জোর দেওয়া হয়। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার্থী কিংবা মেধার ওপরে জোর দেওয়া হয় কম। এ ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি, ফল ভালো দেখানোর মাধ্যমে সরকারের কৃতিত্ব দেখানোর প্রচেষ্টাও রয়েছে যথেষ্ট। আবার অভিভাবকরাও ভালো ফলকেই প্রত্যাশা করে। কিন্তু এবার ঠিক ‘ফল বিপর্যয়’ না ঘটলেও তিক্ততা ভর করেছে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর হৃদয়ে। তাদের বেশিরভাগই কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জন করতে পারেনি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
তবে বাস্তবতা হলো, উচ্চ মাধ্যমিকের ফলের পরই উচ্চশিক্ষার যে ধাপের জন্য শিক্ষার্থীরা লড়াই করে, সেটির জন্য ভালো কিংবা খারাপ ফলের চেয়ে সুযোগ পওয়ার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় জিপিএ ৫ পেয়েও শিক্ষার্থীদের অনেকেই আশানুরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে না। আবার অনেক সময় অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ নিয়ে ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আবার দেখা যায়, রাজধানীর কিছু বেনামি কলেজে জিপিএ ৫ কেনাবেচা হয়। টাকার বিনিময়ে জিপিএ ৫ ক্রয় এবং পাস করিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি গণমাধ্যমের কয়েকটি প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে।
বিভিন্ন কারণেই উচ্চ মাধ্যমিকে সদ্য ফলাফলধারী শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য, ভবিষ্যৎ এবং করণীয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি চিন্তিত। কারণ বাংলাদেশে যেভাবে প্রত্যাশিত ফল নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাঁধে, সেভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা পূরণ হয় না। এ জন্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ধরন এবং এর বাস্তবমুখী প্রয়োগ ও সুযোগের পদ্ধতিগত দিককেই দায়ী করা যায়। বিগত কয়েক বছর আগে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ঢালাও পাসের হার লক্ষ করা যাচ্ছিল। পাশাপাশি জিপিএ ৫ পাওয়ার একটা রমরমা লক্ষ করছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল সেদিক থেকে অনেকটা ব্যতিক্রম হতে চলেছে।
তবে বিগত বছরগুলোতে আমরা লক্ষ করেছি জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই তাদের আশানুরূপ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকদের বেশিরভাগই পর্যায়ক্রমে পিএসসি, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলের সঙ্গে সঙ্গে একটি বিরাট স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেন। যার প্রথম হোঁচটটি খেয়ে যায় উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে আশানুরূপ প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে। তবে হ্যাঁ, প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই প্রত্যাশিত প্রথম জায়গাটিতে বসতে পারবেন, এমন কথাও ঠিক নয়। কিন্তু যদি জিপিএ ৫ পাওয়া সর্বোচ্চ রেজাল্টধারী কোনো শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিতে না পারেন, তাহলে এ রাষ্ট্রের কাছে তার আর চাওয়ার কী থাকতে পারে?
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, উভয় পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া এসব শিক্ষার্থীর সংখ্যার অনুপাতে ভালো বা কাঙ্ক্ষিত বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই। শুধু তাই নয়, উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট পরিমানে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। যখন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী তার মেধার যথাযথ এবং কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পায় না, তখন সে এ জাতির জন্য কতটুকুই বা কল্যাণকর হতে পারে? সাধারণত দেখা যায় যে, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় না ঘটলে সেখানে সৃষ্টি হয় চরম হাতাশা। আর এমন হতাশাই সৃষ্টি করে সমাজে নানাবিধ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।
এর পরও অনেক মেধাবীই কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পায়। সর্বোচ্চ ডিগ্রিটি অর্জন করেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে জন্ম হয় আরো অনেক বড় বড় স্বপ্ন। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী তার স্বপ্নগুলো লালনের মধ্য দিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করেন। তার পরেই শুরু হয় শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আর সেটি হলো কাঙ্ক্ষিত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের যুদ্ধ। আর এ যুদ্ধে যথাযথভাবে বিজয়ী হলেই কেবল তার প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও প্রাপ্তির যথাযথ সমন্বয় ঘটে। কিন্তু শতকরা কতভাগ শিক্ষার্থী তার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়? এ ধরনের সমন্বয় ঘটাতে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীই ব্যর্থ নাকি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততা? ইদানীং দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন শেষে চাকরির বাজারে এসে মুখ থুবড়ে যায়। তখন তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়। সমাজের যেকোনো স্তরের মানুষই চায় তার সন্তানের সফলতা, আর এই সফলতা যখন হাতে ধরা দেয় না, তখন অনেকেই চেষ্টা করেন যেকোনো উপায়ে তা ধরার। বর্তমানে এ দেশের মানুষের বেশিরভাগের মধ্যেই একটি ধারণা বদ্ধমূল হতে শুরু করেছে যে, অর্থ-সম্পদ কিংবা টাকা-পয়সা না দিলে চাকরির নামের সোনার হরিণটি কিছুতেই হাতে পাওয়া সম্ভব না। এ সূত্র ধরে অনেকেই খুঁজে বেড়ায় কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে এই সোনার হরিণটি। বর্তমানে সোনার হরিণের বাজারও অনেকেই খুঁজে পেয়েছেন। প্রায়ই শোনা যায়, দেশের মন্ত্রী, সাংসদ, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা আমলা, সমাজের প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও তাদের নিকটস্থ ব্যক্তি, যারা চাকরি নামের সোনার হরিণ বিক্রির বাজারে পরিণত হয়েছেন।
প্রকৃতপক্ষে এসব মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা এবং রাজনীতিবিদের আত্মীয়স্বজন অথবা পরিবারের কোনো অসৎ ব্যক্তির মাধ্যমে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পথ মাঝেমধ্যেই খোলা পাওয়া যায়। দেশের হাজার হাজার মেধাবী সন্তান নিজের যোগ্যতায় যখন চাকরি নামের সোনার হরিণ পেতে ব্যর্থ হয়, তখনই ওইসব চক্রের শরণাপন্ন হন। কিন্তু এ যাত্রাতেও অনেকেই হোঁচট খেয়ে যায় কিংবা অনেকেই কাঙ্ক্ষিত ধাপে পৌঁছাতে পারেন না। তাহলে এই সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রের অধিকর্তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, ধীরে ধীরে লালন করা এই স্বপ্ন যখন ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তখন এর পরিণতি কী?
লেখক : ড. সুলতান মাহমুদ রানা, সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্রফেশনাল স্টাডিজ।