অভিমত
কে থামাবে সড়কযাত্রায় মৃত্যুর মিছিল?
সড়ক দুর্ঘটনা এখন আমাদের জাতীয় সমস্যা। বেশ কয়েকবছর ধরেই বাংলাদেশের সড়কগুলোতে চলছে মৃত্যুর গণমিছিল। ঈদ উৎসব এলে এই ধারাটা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। এবারের ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফিরতে গিয়ে অর্ধশত মানুষ একদিনে অকালে তাদের জীবন সমর্পণ করেছে। পুরো ঈদযাত্রায় সড়ক, রেল ও নৌপথে ৩৩৫টি দুর্ঘটনায় ৪০৫ জন নিহত এবং ১২৭৪ জন আহত হয়েছে বলে যাত্রী কল্যাণ সমিতি তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে। তবু অনিরাপদ সড়কের ভয়াল ক্ষুধা একটুও কমেনি। এখনো প্রতিদিনই নতুন মানুষের প্রাণপাত হয়ে চলছে। কিন্তু আমাদের কোনো বিকার নেই। প্রতিবাদ নেই। প্রতিকার চাওয়া নেই। কর্তৃপক্ষেরও কোনো জবাবদিহিতা নেই।
সড়ক চলাচলে রোজই মানুষকে তাঁর প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে যানবাহনে চড়তে হবে, এতে প্রাণ গেলে কিংবা শরীরের হাড়গোড় ভেঙ্গে গেলে কারো কোনো অভিযোগ থাকতে নেই, কোথাও কোনো আলোচনাও হতে নেই। সব দুঃখ এখন আমাদের গা সওয়া। স্বজনের মৃত্যশোকও আজকাল কারো বুকে বেদনার উদ্রেক করে না। অমূল্য জীবনকে বাঁচিয়ে রাখবার সংগ্রাম নয়, বেখেয়াল সস্তা মৃত্যুর কাছে আলগোছে অপঘাতে জীবন সমর্পণই এখন মানুষের করুণ নিয়তি।
এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের সড়ককে সাবলীল ও নিরাপদ রাখার দায় যাদের সেই সব দায়িত্বশীল মানুষের নীরবতা আর নির্বিকারতায় দেশের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই মুখ খুলতে হয়েছে, কড়া নির্দেশনা দিতে হয়েছে তাঁকে। প্রধানমন্ত্রী সড়ক বিশেষজ্ঞ নন, কিন্তু হাজার সড়ক প্রকৌশলী বা গবেষক যখন এতটা বিপর্যয়ের পরও জবান বন্ধ করে রেখে খুব স্বাভাবিক নিয়মে প্রজাতন্ত্রের অর্থকড়ি গ্রহণ করে যায়, আরাম আয়েশ করে, বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণে সময় পার করে, অগত্যা প্রধানমন্ত্রীর কথা না বলে আর উপায়ও থাকে না। সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছাড়া এখন সবাই যেন কাজ করতেও ভুলে গেছে।
ঈদের পরে সড়কে মৃত্যুর মহামারি দেখে সড়কমন্ত্রীর টনক না নড়লেও গেল ২৫ জুন মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কড়া নির্দেশনা দেন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নিম্নোক্ত পাঁচ নির্দেশনা কার্যকরের কথাও বলেন তিনি :
১. চালক ও হেলপারদের (সহকারী) প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
২. দূরপাল্লার বাসযাত্রায় বিকল্প চালক রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাঁচ ঘণ্টা পরপর চালক পরিবর্তন করতে হবে।
৩. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৪. চালকদের জন্য মহাসড়কের পাশে বিশ্রামাগার রাখতে হবে।
৫. এবং অবশ্যই সিগন্যাল মেনে চলতে হবে।
পরে সরকারের তরফে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিবৃতিতে জানান, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সকলে অনুসরণের মধ্য দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এসব নির্দেশনা কার্যকরের বিষয়টি তদারকি করবেন বলেও জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত নিয়ম হচ্ছে, দূরের যাত্রায় একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশে এমন বিধান কার্যকর করার ক্ষেত্রে উল্লেখিত তিন হেভিওয়েট মন্ত্রী কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে বোধ হয় না। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে। গাড়ির চালক ও সহকারীরা যাত্রীর পকেট কাটার ধান্ধায় নানা ছলচাতুরি আর বাহানার ফন্দি আটেন। প্রতিবাদ করতে গেলে হরহামেশাই যাত্রীর সাথে বচসা এমনকি ঠুকোঠুকি পর্যন্তও লেগে যায়। ভাঙ্গা রাস্তায় অপ্রতুল যানবাহনের ঝক্কি নিয়ে মানুষকে রোজ গণপরিবহনে চড়তে হয়। নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়েছে অনেক আগেই। রাজধানী ও এর আশপাশের জেলা শহরগুলোতে যানজট এক মহাবিড়ম্বনার নাম। আর দূরপাল্লার যাত্রা মানেই মারাত্মক দুর্ঘটনার ভয়ংকর পরিণতি।
বাংলাদেশে রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি অ্যাক্ট, রোড ট্রান্সস্পোর্ট অ্যাক্ট বলে বিবিধ আইনকানুন প্রচলিত আছে। কিন্তু এসব আইন মান্যতার পরিসংখ্যান বরাবর জিরো পার্সেন্ট। এ দেশে আইন না মানলে শাস্তি হয় খুব কম ক্ষেত্রেই। এমন বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হিমাগারে যেতে খুব বেশি সময় লাগার কথা না। এই নিয়ে কোনো আলোচনা আমরা এখন আর শুনছিও না। অথচ প্রধানমন্ত্রী প্রদত্ত পাঁচটি নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা গেলে সড়ক সম্পূর্ণ নিরাপদ না হোক, দুর্ঘটনা একেবারে কমে না আসুক, একটা ইতিবাচক ফলাফল আমরা আশা করতেই পারি।
দুর্ভোগ দুর্ঘটনার জন্য শুধু সড়ক সংশ্লিষ্টদের ওপর দায় চাপিয়ে লাভ নেই। অমানুষিক পরিশ্রম করা সড়ক শ্রমিকরা আমাদেরই ভাইবেরাদর বা স্বজন। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত উপযুক্ত বিধিবিধানের ছাঁচে যদি তাদের ফেলা না যায়, প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশনাল সেশন না দেওয়া যায় তবে তাদের দুর্মতি বা দুর্বুদ্ধির পরিবর্তনটা হবে কীভাবে? আমরা শুধু রাস্তা ভালো চাই। কিন্তু রাস্তা নির্মাণ বা সংস্কার করতে গিয়ে যে প্রকল্প বরাদ্দের টাকা ঘাটে ঘাটে ভাগাভাগি হয় তার বিষয়ে প্রতিবাদমুখর হই না। নিজেদের বোধ-বিবেকও ফেরাই না। সস্তার তিন অবস্থার যাতাকলে আমরা সবাই মিলে পিষে মরব কিন্তু অসাধুতা বন্ধ করব না।
সামগ্রিকভাবে আমাদের চারিত্রিক অধপাত ঠেকানোর ব্যবস্থা সবার আগে করতে হবে। দুর্নীতির ঘোড়ারোগটার দাওয়াই খুঁজতে হবে। তা নাহলে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশের তালিকায় থাকা প্রাণের বাংলাদেশের নামটা কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না। লুটপাট বা স্বেচ্ছাচারিতার মতো সকল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিভিন্ন সামাজিক সূচকে আমরা অগ্রগামী। অর্থনৈতিক অবস্থাও দিনদিন পাল্টাচ্ছে, সেখানে সড়ক নিরাপত্তার পারদ কেন আমরা ওপরে তুলতে পারব না?
আমাদের বক্তব্য একটাই, কোল্ড স্টোরেজে ফেলে না রেখে প্রধানমন্ত্রীর ভাবনাপ্রসূত সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে পাঁচ নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর করবার পদক্ষেপ নেয়া হোক। দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন মন্ত্রীকে দেখাতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তাদের কিছু যায় আসে! আর দেশজুড়ে সড়কমন্ত্রীর রাস্তা পরিভ্রমণ নয় শুধু, কাজ করে দেখানোরই সময় এটা। মানুষের জানমাল যদি নিরাপদ না থাকে, সড়ক যাত্রায় যদি মৃত্যুর মহামারি বন্ধ করা না যায়, তবে উন্নয়ন ধুয়ে জল পান করবার জন্য একজন মানুষও আর অবশিষ্ট থাকবে না।
লেখকঃ সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন