সমসাময়িক
স্লুইসগেট: পানি আসে পানি যায়
১.
নানা উন্নয়ন পরিকল্পনা আর কমিশনের ফাঁদে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোকে গ্রেফতার করে ফেলা হয়েছে, মেরে ফেলা হয়েছে। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’ স্লোগান দিয়ে যে বদ্বীপ এলাকার জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, সেই দেশের মানুষই অনুচ্ছেদ ৮(১)-এর শর্তাংশ “তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়” এবং অনুচ্ছেদ ৮০(৩) “এবং সেই সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না” ব্যবহার করে নদ-নদীগুলো হত্যা, প্রাকৃতিক রিজার্ভার খাল-বিলগুলোকে শুকিয়ে বারোটা বাজিয়েছে।
সেই ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসেই পরিকল্পনাবিদ ও নদী গবেষক শফিউদ্দিন সরকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ১১তম সম্মেলনে প্রশ্ন তুলেছিলেন : জিকে প্রজেক্টে যেখানে ১০ কোটি টাকার বিনিময়ে তিন লাখ ৬৫ হাজার একর জমিতে জলসেচের কথা বলা হয়েছিল, সেখানে মাত্র ৬৫ হাজার একর জমিতে জলসেচ করা হচ্ছে; যেখানে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে ১৪ লাখ একরে জলসেচের কথা বলে টাকা ঢালা হলেও করা হচ্ছে মাত্র এক লাখ একরে। তাহলে বাকি টাকা গেল কোথায়?
গেল আগস্ট মাসের মধ্যভাগে কুড়িগ্রাম জেলায় মাত্র সপ্তাহখানের টানা বৃষ্টিতে ও অপরিকল্পিত বাঁধের কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে ফসলি জমি তলিয়ে গিয়েছে। গত আগস্ট মাসের শেষদিন পর্যন্ত পানি স্লুইসগেটগুলো হয়ে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তাসহ অন্যান্য নদনদীতে নেমে যাচ্ছিল। ওই তারিখের পর পানি আর না নামলেও চলত। আমন ধান, মাছ, কাঁকড়া, শামুকের জন্য এই পানির দরকার ছিল। ফলে কৃষকরা পানির খরচ ছাড়াই আমন ধান ঘরে তুলতে পারতেন। কিন্তু সেদিন দিবাগত রাত থেকেই নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে আবার স্লুইসগেট দিয়ে আমন জমির এলাকায় পানি ঢুকে পড়ছে। অথচ স্লুইসগেটগুলো বন্ধ করা গেলে যে মঙ্গার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তা শুনতে হতো না। উল্টো এবার কৃষক ও জেলেদের মুখে হাসি ফুটত।
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার পাত্রখাতা-মাঝিপাড়া এলাকার স্লুইসগেট সংলগ্ন দোকানি হাফিজুর (৩৫) জানান, তিনি গত ১০ বছরে গেট বন্ধ করতে দেখেন নাই, পানি নিজ গতিতে ঢোকে, নিজ গতিতে বেরোয়। এই বিষয়ে গণকমিটির জেলা সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমাদের উপজেলা কমিটির নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে নির্বাহী কর্মকর্তাদের অবহিত করেছেন। আমিও কথা বলেছি।’
আর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমানের সঙ্গে কথা বললে তিনি আজকেই এই বিষয়ে যথাযথ নির্দেশ দেবেন বলে জানান। এই স্লুইসগেটে কর্মচারীর পরিবার নিয়ে থাকার জন্য যে ছাদ পেটানো বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল, অব্যবহারে সেই বাড়ি শুধুমাত্র কাঠামোটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাত্র। দেশজুড়ে এ রকম হাজার হাজার স্লুইসগেট নিধিরাম সর্দারের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
২.
হাজার নদীর দেশে নদী ব্যবস্থাপনা ধার করতে হয় বরফের দেশ থেকে। চিন্তক কলিম খানের চিন্তা ধার করে বলতে হয়, আমাদের চিন্তা বাঁধা আছে পাশ্চাত্যের ‘রিভার’ কাঠামোয়। অথচ এখানে রিভারের লিঙ্গভেদ আছে, দারা-পুত্র-পরিবার আছে। কেউ আকাশগঙ্গা হয়ে আকাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়, কেউ ভোগবতী হয়ে পাতাল দিয়ে। কোনোটির জন্ম অশ্রু থেকে, কোনোটির বীর্য থেকে, কোনোটির বা গান শুনে গলে গিয়ে। যেই দেশে নদ-নদীকে এভাবে ভাবা হয়, প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় ইউরোপীয় মডেলে, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প অনুসারে। ফলে নদ-নদীতে যৌবন এলে ফসল নষ্ট হবে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, মরুকরণ ছড়িয়ে পড়বে-এটাই স্বাভাবিক!
বিশ্বখ্যাত নদী প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স গণভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাংলার প্লাবনভূমিতে অবাধে পানি প্রবাহিত করার কথা বলতে গিয়ে ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সেচই হলো পৃথিবীর আদিতম ফলিত বিজ্ঞান; প্রাচীনতম সেচকেন্দ্রগুলো ছিল একই সঙ্গে আদিতম সভ্যতারও পীঠস্থান। কেননা বিস্তৃত আকারে ফলপ্রসূ সেচব্যবস্থাই হয়ে ছিল এবং হয়ে আছে সভ্যতার মহান পাঠশালা। সফলভাবে বিরাট আওতায় সেচকার্য চালানো সম্ভব হতো না যদি সবার মাঝে সমঝোতা ও পরস্পরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকত এবং একতাবদ্ধ হয়ে না মানা হতো নিজেদের তৈরি নিয়মকানুন। চূড়ান্তভাবে, নিজেদের বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ ব্যবহারের পথে স্বাস্থ্যকর পরিপার্শ্বের মধ্যে বিপদমুক্ত সমৃদ্ধ জীবনযাপন করা সম্ভব হয়েছিল। বাংলার আদি সেচকারীদের এবং তাঁদের উত্তরসূরিদের সামনে যেসব সমস্যা হাজির হয়েছিল, তা সফলভাবে মোকাবিলার মধ্যদিয়ে প্রমাণ হয়েছিল তাঁদের মস্তিষ্কের সন্দেহাতীত ক্ষমতা এবং তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল পারস্পরিক সহযোগিতার আবেগ।”
একই কথা বলেছেন আধুনিক সেচব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা স্যার আর্থার কটনও। অথচ লাখ লাখ মানুষের রক্ত দানে অর্জিত বাংলাদেশের সেচব্যবস্থায় নদ-নদীগুলোকে হত্যা, খাল-বিল শুকিয়ে উদোম প্রান্তর বানানো হচ্ছে। আর স্লুইসগেটগুলো একেকটা হয়ে উঠেছে নরকের দরজা।
লেখক : প্রধান সমন্বয়, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।