কাপযুদ্ধ
জয় হলো জাপানি ফুটবল দর্শনের
ভূমিকম্প। সুনামি। এসব খুব পরিচিত শব্দ জাপানিদের কাছে। ভূমিকম্পের একটা ভয় তাদের মনের কোণে উঁকি দিয়েছিল কলম্বিয়ার বিপক্ষে মাঠে নামার আগে। ভয় কেন, রীতিমতো আতঙ্ক আর শঙ্কা নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন জাপানি ফুটবলাররা। ওসাকায় ভূমিকম্প হলো। নয় নয়জন মানুষ মারা গেল। কিন্তু বিশ্বকাপেও যেন জাপানিদের সামনে ভূমিধ্বসের মতো ধসে পড়ল কলম্বিয়া! এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ল্যাটিন আমেরিকান কোনো দেশের বিপক্ষে বিশ্বকাপে জয়ের পতাকা ওড়ালো জাপান।
ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে অনেকে পড়েছেন জাপান সূর্য উদয়ের দেশ। জ্যোতির্বিজ্ঞানে এ নিয়ে তর্কাতর্কি থাকতে পারে, কিন্তু এশিয়ানদের কাছে এখনো সম্ভবত জাপান সূর্যোদয়েরই দেশ! কারণ বিশ্বকাপ ফুটবলে সেটা আরো একবার মনে করিয়ে দিল জাপানিরা। তারাই প্রথম এশিয়ান দল, যারা ফুটবল বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ল্যাটিন দল কলম্বিয়াকে হারিয়ে এশিয়ান ফুটবলের জয়গান গাইল রাশিয়ায়।
আধুনিক প্রযুক্তি, আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প এসবকে পেছনে ফেলে জাপানিরা ফুটবলেরই জয়গান গাইছেন এখন। জাপানের ফুটবল সংস্কৃতি, ফুটবল দর্শন এশিয়ার বাকি দেশগুলো থেকে মনে হয় একটু আলাদা। জাপানিদের ফুটবল দর্শনে পরিবর্তনের পথিকৃত অবশ্য এক ব্রাজিলিয়ান। যার নাম জিকো। ব্রাজিলিয়ান এক ফুটবল কিংবদন্তি। তিনিই জাপানের দায়িত্ব নিয়ে তাদের মাঝে ফুটবল নিয়ে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন। বুঝাতে পেরেছিলেন ফুটবলে জয়-পরাজয় থাকবে। কখনো জিতবে। কখনো হারবে। কখনো বা হারজিৎ কোনোটাই হবে না। তবে ফুটবল নামক সুন্দর খেলাটা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায়। যেমন করেছে ব্রাজিল। সেই দর্শনে বিশ্বাসী হয়েই জাপানিরা ফুটবল খেলছে। তারপর তারা যৌথভাবে বিশ্বকাপের আয়োজকও হয়েছে এই দশকের গোড়ায়। নিজেরা বিশ্বকাপের নক আউট পর্যায়েও গেছে। তারপরও জাপানিদের কাছে সাফল্যের চেয়ে এখনো বড় বিষয় আনন্দ।
স্কোর লাইন দেখে জয়-পরাজয় বোঝা যায়। ওটাই ফলাফল মাপার অংক। কিন্তু ফুটবলের সৌন্দর্য মাপার কোন সূচক কী কল্পবিজ্ঞানেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ফুটবলানন্দ, সৌন্দর্য, আবেগ এসব মাপার কোনো যন্ত্র নেই। চোখ দিয়ে আপনি হয়তো সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। তবে সেটা আপেক্ষিক। হৃদয় দিয়ে আবেগটা অনুভব করতে পারবেন। মন দিয়ে আনন্দ উপলব্ধি করতে পারবেন। কিন্তু ২০ জুন বুধবারের জাপানি পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলে মনে হবে, জাপানিদের সুখ আর আনন্দের তীব্রতর একক হচ্ছে পত্রিকাগুলোর শিরোনাম। জাপানি ফুটবলের জয়জয়কার। বিশ্বকাপে জাপানিদের জয়গান ছাড়া সেখানে অন্য কিছু খুঁজে পাওয়া দায়।
গত শতাব্দির বিশ্বযুদ্ধে জাপান ক্ষতিগ্রস্থ এক দেশ। যুদ্ধ বিমান থেকে ছোঁড়া বোমা কেড়ে নিয়েছে কত মানুষের প্রাণ। জাপানিরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম, বছরের পর বছর সেই শোক আর দুঃখগাথা হৃদয়ে বয়ে বেড়াবে। কিন্তু কলম্বিয়াকে হারানোর আনন্দটা অন্তত একদিনের জন্য হলেও তাদের অনেক কিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। না, কলম্বিয়ার সাথে তারা সে সময় বিশ্বযুদ্ধে জড়ায়নি। কিন্তু বিশ্বকাপ। সে তো ফুটবল ঘিরে এক মহাযুদ্ধ। যাকে ফুটবলীয় বিশ্বযুদ্ধ বললেও খুব বাড়িয়ে বলা হবে না। জার্মানি, রাশিয়া, ব্রিটিশ, ফ্রান্স, স্পেন-পর্তুগাল পশ্চিমা বিশ্বের কত বড় বড় শক্তি। তারা সবাই আছে এই মহাযুদ্ধে। আর আছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার মতো ফুটবলীয় পরাশক্তি। যাদের পাশের দেশ কলম্বিয়া। ঝঁকাড়া চুলের সেই ভালদেরামার কলম্বিয়াকে হারানো, সেটা কম বড় কথা নয়। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ না হোক, মানুষের হৃদয় জয়ের অনাবিল এক আনন্দ কী ছুঁয়ে যায়নি জাপানিদের!
শেষ ষোলতে এবার জাপান পৌঁছাবে কি না সেটা সময় বলে দেবে। কিন্তু একটা ল্যাটিন দেশকে হারাল জাপান। সেটা ইতিহাস হয়ে থাকল বিশ্বমঞ্চে কোনো এশিয়ান দলের প্রথম জয় হিসেবে। হোক না সেটা দশজনের দলে পরিণত হওয়া কলম্বিয়া। স্কোর লাইনে কী আর সেটা লেখা থাকবে! ক্রিকেটে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়; পরিসংখ্যান হচ্ছে একটা গাধা। বহুচর্চিত সেই শব্দটাকে আবার মনে করতে হচ্ছে এবং একটু অন্যভাবে মনে করিয়েও দিতে হচ্ছে ফিফা র্যাঙ্কিং হচ্ছে নিছক কিছু সংখ্যা। বিশ্বকাপ মঞ্চে ঐ র্যাঙ্কিং দেখে কারো ফুটবলীয় শক্তি মাপতে গেলে ভুল হবে। জাপানিরা অত্যাধুনিক যত প্রযুক্তির মালিক হোক না কেন, ফিফা র্যাঙ্কিংকে ভুল প্রমাণ করতে কোনো যন্ত্র লাগেনি তাদের। সে দেশের ফুটবলাররা মন উজাড় করে খেলে ফিফার র্যাঙ্কিং নামক সংখ্যাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন বিশ্ববাসীর কাছে। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে কলম্বিয়ার নামের পাশে ১৬। আর জাপানের পাশে ৬১। কিন্তু মঙ্গলবার রাশিয়ায় সেটাকে পাল্টে দিলো জাপান। স্কোর লাইন বলছে জাপান ২, আর কলম্বিয়া ১! তাহলে ওই ১৬ আর ৬১ নিছক সংখ্যা ছাড়া অন্য কিছু কী!
তবে হ্যাঁ, জাপানকে ফুটবল বিশ্বকাপ নামক মহাযুদ্ধে আরো অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে নিজেদের ফুটবল সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে। গোলের জন্য খেল, জিকোর শেখানো ফুটবল দর্শন অনুসরণ করে পারবে কি জাপানিরা নিজেদের আরো খানিকটা উঁচ্চুতে তুলে ধরতে?
লেখক : সিনিয়র স্পোর্টস জার্নালিস্ট এবং কলাম লেখক।