অর্থনীতি
কেমন বাজেট চাই
মহান জাতীয় সংসদে বরাবরের মতো এবারও জুনের ৭ তারিখ বাংলাদেশ সরকারের বাজেট উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। এটি হবে সরকারের বর্তমান মেয়াদের শেষ বাজেট। অনেকে এটাকে নির্বাচনী বাজেটও বলছেন। অনেকে আবার অনেক চমকের কথাও বলছেন। আমরা অত চমকে বিশ্বাস করি না। আমরা চাই, বাজেটে বাস্তবতার প্রতিফলন। চলতি ২০১৭-১৮-এর বাজেটে অনেক কাটছাঁট করা হয়েছে। ২০১৮-১৯-এর বাজেটেও যদি সে রকম কিছু করতে হয়, তাহলে চমকের প্রয়োজনই নেই।
আসন্ন বাজেটে আমরা ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমূল কাঠামোগত সংস্কার দেখতে চাই। আমরা চাই শিক্ষাবান্ধব বাজেট। শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ অন্তত তিন গুণ বৃদ্ধি দেখতে চাই আমরা। আর এ খাতের উন্নয়নে এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ দেখতে চাই। আমরা চাই পরিবহন অবকাঠামো, বিশেষ করে রেলবান্ধব বাজেট। চলতি বাজেটে রেলের জন্যে মাত্র ১৬ হাজার ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর উন্নয়নে মাত্র ১৩ হাজার এক কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এটা খুবই অপ্রতুল। রেলের উন্নয়নে বরাদ্দ আগামী বাজেটে বর্তমানের তিন গুণ করা আবশ্যক বলে আমি মনে করি, অর্থাৎ কোনোমতেই এ বরাদ্দ ৪০ হাজার কোটি টাকার কম হওয়া উচিত নয়। আমরা আরো চাই নৌপরিবহনবান্ধব বাজেট। আমি এ বিষয়ে আমার অতীতের অনেক লেখায় বলেছি যে, ‘নদী শাসন ও খনন (River Management and Dredging Ministry)’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি করা হোক। নদী ও সমুদ্র হচ্ছে আমাদের দেশের অর্থনীতির জীবন-প্রাণ। ২৪ হাজার কিলোমিটার নদী ১০-১৫ মিটার গভীরতায় ধরে রাখতে পারলে তার থেকে যে অর্থনৈতিক সুফল পাওয়া যাবে, তা হিসাব করে কূল করা যাবে না।
প্রথমত, বিপুল পরিমাণ মিষ্টি পানির আধার হিসেবে কাজ করবে নদীগুলো, এমনকি খাল-বিলও। দ্বিতীয়ত, বিপুলসংখ্যক মাছের আধার হবে এগুলো। তৃতীয়ত, শিল্পের জন্য মিষ্টি পানির উৎস হিসেবে কাজ করবে এগুলো। চতুর্থত, নৌপথে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং সর্বশেষে যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা আরো সম্প্রসারিত হবে। পানির মূল্য দিতে হয় না বিধায় সারা বিশ্বে নৌপরিবহন সবচেয়ে সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃত। ঐতিহাসিকভাবে আমরা চারটি নদী প্রণালি পেয়েছি। প্রকৃতি স্বহস্তে আমাদের চার-চারটি নদী প্রণালি উপহার দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে যথাক্রমে গঙ্গা-পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র-যুমনা, মেঘনা ও কর্ণফুলী নদী প্রণালি। এদের মধ্যে অন্তত দুটি (গঙ্গা-পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র-যমুনা) মৃতপ্রায়। বাকি দুটির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। যে কারণে ২৪ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদী সারা বছর নাব্য থাকে। ফলে আমাদের দেশ নদীর বিশাল সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আর একটি উপখাতের জন্য আমি আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রস্তাব করব। আর সেটি হচ্ছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ উপখাত। এ খাতের বরাদ্দ চলতি বাজেটে মাত্র দুই হাজার ৫২৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে উন্নয়নে মাত্র এক হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। এটা অত্যন্ত অপ্রতুল। আমাদের ডাকঘরগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। প্রায় সাড়ে আট হাজারের মতো ডাকঘর রয়েছে আমাদের দেশে। এগুলোকে উন্নত বিশ্বের ডাকঘরের আদলে আধুনিক ডিজিটাল ডাকঘরে রূপান্তর করা জরুরি। ডাকঘরগুলোতে সেবার মান ও সংখ্যা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি। এখানে ফলমূল থেকে আরম্ভ করে কাপড়চোপড় পর্যন্ত যাবতীয় জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ কাজটি সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন মাপের কাগজের বাক্স, টেপসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ডাকঘরে যথেষ্ট পরিমাণে ও সংখ্যায় থাকতে হবে। এ ছাড়া জনগণকে আরো নতুন ধরনের সেবা প্রদানের পথ ও পদ্ধতি প্রতিনিয়ত আবিষ্কার ও তার প্রচলন ঘটাতে হবে। এতে করে ডাকঘরগুলো থেকে আয়ও অনেক বৃদ্ধি পাবে।
নিজস্ব ব্র্যান্ডের মোবাইল, ল্যাপটপ ও অন্যান্য কম্পিউটার ও টেলিফোন সামগ্রী উৎপাদনে যেতে হবে। এ উদ্দেশে টঙ্গী টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং এর আধুনিকায়ন করে উপরোক্ত পণ্যসমূহ উৎপাদনের অবস্থায় নিয়ে যেতে হবে। আর এ জন্য যদি দুই হাজার কোটি টাকা লাগে, তাও দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। পাটের মতো এ ক্ষেত্রেও আইন করে দিতে হবে এই মর্মে যে, সমস্ত সরকারি, আধা-সরকারি অফিসে ও প্রতিষ্ঠানে দেশি, বিশেষ করে টঙ্গী টেলিফোন শিল্প সংস্থায় উৎপাদিত উপরোক্ত পণ্যসামগ্রী বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
এতদ্ব্যতীত, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং কৃষিতে চলমান উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় অবশ্যই বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। জনশৃঙ্খলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর সদস্য সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হবে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি পণ্য দিতে হবে তাদের। মনে রাখতে হবে যে, ১৭০ মিলিয়ন মানুষের নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা বিধানে বর্তমানের বাহিনীগুলোর সদস্য সংখ্যা মোটেও যথেষ্ট নয়। এখনো আমাদের দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা বিদ্যুৎহীন অবস্থায় আছে। কাজেই এ অন্ধকার এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ দেওয়া এবং মানসম্মত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার স্বার্থে এ খাতের বরাদ্দও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে। অন্যদিকে কৃষিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ব্যাপারটি কিছুতেই উপেক্ষা করা যায় না। কারণ কৃষিতে গবেষণা কার্যক্রম বৃদ্ধি ও কৃষির বহুমুখী করণের স্বার্থে এ খাতের বরাদ্দ যথেষ্ট পরিমাণে বাড়াতে হবে।
পরিশেষে আমি বিশ্বাস করি যে, আসন্ন বাজেটে যদি উপরোক্ত বিষয়গুলোতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং তা বাস্তবায়িত হয় তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগ, হোক তা স্বদেশি বা বিদেশি, বিনিয়োগ নিয়ে আর ভাবতে হবে না। আমাদের দেশ বিনিয়োগ নিয়ে কুলোতে পারবে না। দেশ হবে আধুনিক, শিল্পায়িত ও সমৃদ্ধ এক দেশ, যাকে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বলতে পারব, এমন প্রত্যাশাই করি।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।