অভিমত
সৌদিফেরত নারীদের আর্তনাদ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা এখনো রয়ে গেছেন অন্ধকারে। সে তালিকায় বাংলাদেশ বাদ যায় না, বাদ যায় না সৌদি আরবের নামও। আমরা জানি, সৌদি আরবে দিনের পর দিন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশি নারী কর্মীরা। তাঁদের অনেকেই নির্যাতন সইতে না পেরে দলে দলে ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে এসে নামছেন। তাঁদের ভেতরের চাপা কান্নাগুলো অশ্রুজল হয়ে ঝরছে বিমানবন্দরের বহির্গমন পথের মেঝেতে।
কী অন্যায় করেছিলেন এই নারীরা? একটুখানি নিরাপদ ভবিষ্যতের আশা, সন্তানদের মুখে দুমুঠো অন্ন ঠিকঠাক তুলে দেওয়া, ছনে ছাওয়া ঘরে টিনের ছাউনি দেওয়া, উৎসবে পার্বণে প্রিয়জনদের একটু ভালো খেতে-পরতে দেওয়ার চেষ্টা করা—এই তো? এইসব চাওয়া, এইসব স্বপ্ন তাঁদের ছিল। এটা কি খুব অন্যায় চাওয়া ছিল? মুনাফালোভীরা তাঁদের এইসব স্বপ্ন আর চাওয়াকে করেছে হাতিয়ার।
বেশ কিছুদিন ধরে সৌদি থেকে ফেরত আসছে একের পর এক এমন নির্যাতিত নারীর দল। অথচ এক দেশের নাগরিককে অন্য দেশের নাগরিক নির্যাতন করার অধিকার নেই—তবু এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ নেই সৌদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। ‘গভীর উদ্বেগ’ জাতীয় কোনো শব্দ নেই কারো মুখে। এই রাষ্ট্রের নারীরা পদে পদে এমন লাঞ্ছিত হলে রাষ্ট্রের কিছু যায় আসে না। বরং রাষ্ট্র দেখাতে চায়, ‘আমরা নারীদের বিদেশে কর্মসংস্থান করেছি’! কর্মসংস্থানের এই যদি নমুনা হয়, কর্মসংস্থান মানে যদি হয় শারীরিক, মানসিক আর যৌন নির্যাতনের চুক্তিবদ্ধ চাকরি—তবে সেই কর্মসংস্থান দরকার নেই এই দেশের নারীদের।
ফেরত আসা নারীরা বলছেন, দেশে মানুষের বাসায় কাজ করে বা পোশাক কারখানায় কাজ করে তাঁরা অল্প বেতন পেতেন, যা দিয়ে সংসার চলে না। সংসার চালাতে বাড়তি অর্থ দরকার, তাই তাঁরা পা দিয়েছেন দালালের ফাঁদে। দালাল বলেছে, অল্প সময়ে, কয়েক বছরে এমন আয় হবে যা দিয়ে সংসারকে একটা শক্ত ভিত দেওয়া যাবে। সন্তানদের পড়ানো যাবে ভালো স্কুলে। পরিবারের অসুস্থ সদস্যের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা যাবে। সুখের সোনালি স্বপ্নে তাঁদের চোখে ঝিলিক দেয়। কিন্তু মরুর বুকে পৌঁছার পর থেকেই এই নারীরা বুঝে যান, তাঁরা চোরাবালিতে পা দিয়েছেন। বিদেশে পৌঁছার পরপরই তাঁদের দৃষ্টির বাইরে চলে যায় দালাল স্বদেশি। তারপর আগন্তুকের হাত ধরে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ক্রীতদাসের হাটে।
বাকি কিছু আর দেখার দরকার নেই রিক্রুটিং এজেন্সি, দালাল আর সরকারের।
তাঁদের প্রিয় স্বদেশ! ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারই চুক্তি করে সৌদি সরকারের সঙ্গে; দেড় লাখ নারী কর্মী পাঠানোর চুক্তি। চুক্তিতে লেখা থাকে না, নারীদের কী কাজ, কত মাইনে আর কী সুযোগ-সুবিধা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে সৌদি আরবের নারী শ্রমিকরা। তাই পৃথিবীর তাবৎ দেশের লোকেরা সৌদি থেকে তাদের নারী কর্মীদের ফেরত নিচ্ছে। আর বাংলাদেশ সেখানে কর্মী পাঠাচ্ছে। কেন, কার স্বার্থে? এই অতি উৎসাহের পেছনে যে কাঁচা টাকার গন্ধ আছে, পরিচিত রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ আছে, তা সবাই বোঝে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। সরকার কর্মসংস্থানের ঢোল বাজায় আর তাতেই বুঁদ হয়ে থাকে দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন থেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই।
এখন সৌদি ধনশালীদের বাড়িতে বাড়িতে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছেন বহু বাঙালি ক্রীতদাসী; কেউ দেখার নেই, কেউ শোনার নেই! যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই চিৎকার করে বলছেন, ‘সৌদি আরবের ঘরে ঘরে এখনো নিপীড়নে নিপীড়নে কাতরাচ্ছেন অনেক বাঙালি নারী, তাঁদের উদ্ধার করুন, তাঁদের বাঁচান!’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র কি শুনতে পাচ্ছে তাঁদের এই চিৎকার? নিঃস্ব হয়ে এসেও তাঁরা কিন্তু নিজের কথা বলছেন না, বলছেন ফেলে আসা স্বদেশি নারীর কথা। কী এক দুর্বিষহ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বাকিদের বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন, তা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। বালিতে মুখ গুঁজে থাকার মতো কিছুই না শোনার ভান করলে চলবে না। প্রত্যেক প্রবাসী নারীকর্মী এ দেশের নাগরিক। বিদেশের মাটিতে তাঁদের নিরাপাত্তা বিধান করা এবং জীবননাশের হুমকি থাকলে তাঁদের উদ্ধার করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।