বং এক্সপ্রেস
আচারে-বিচারে হৈচৈ
হ্যাঁ, বাঙালি মানে বাঙালিই আর সম্পূর্ণ বং হলেও আচার-বিচারে তারা বেশ সিদ্ধহস্ত! তবে এখানে সেই আচারের কথা যদিও বলছি না, বলছি রসনাতৃপ্তির লালাক্ষরণকারী চিত্তাকর্ষক মুহূর্তের কথা। এহেন গ্রীষ্মকাল, খড়খড়ে কড়কড়ে দুপুর, বিকেলের বিদূষী মেঘ সেখানে মানুষ আচার ছাড়া কিসে আর তেমন সমঝোতা করতে পারে? ডিডি বাংলায় আমাদের ছোটবেলায় সাদাকালো অসাধারণ সব ছবি দেখা যেত দুপুরবেলায়! সেখানে রাজকীয় ইংলিশ খাটে বসে খোঁপা বাঁধা গিন্নি আচার চাটত কিংবা বাড়ির ষোড়শী মেয়েটা যৌবনের আঁকিবুঁকিকে নিষিদ্ধ ভেবে আচার হাতে লুকিয়ে পড়ত ছাদের কোনায়। জীবনে উপকরণ খুব কম ছিল, কিন্তু এখন মনে হয় জীবন বোধ হয় তখন অনেক খাঁটি ছিল। এখন প্রতিটা দিন মুহূর্তের মধ্যে চলে যায় যন্ত্র ও যুগের সঙ্গে তারাও যেন দাসত্ব শিখে গেছে।
এখন আমাদের সব আছে, বড় বেশি আছে তাই অনেক কিছু নেই। বাল্যবিবাহে এসে জীবনের অতৃপ্তি ভরা মেয়েগুলো হাতের মধ্যে আচার লুকোত পাপের ভয়ে আর দুপুরের কোনো এক ঘাটে বসে তা চেটে চেটে খেত, যেন তারই হারিয়ে যেতে থাকা যৌবন সেই চুরি করে খাচ্ছে। এসব জীবনের সঙ্গে আচারের গল্পরা জড়িয়ে, আজকের প্যাক হওয়া সিল করা আচারের কৌটোরা আমাদের টেবিলে এসে বসে দুপুরে খাবার পাশে চামচে করে তারে মাঝেমধ্যে বেরিয়ে আসে। এখন তাদের কেউ তেমন রোদে রাখে না , কৌটো খুলে এক খাবলা তুলে পালিয়ে যায় না ছাদে। আমাদের মতো তারাও এখন ভদ্র।
সে যাই হোক, বাঙালির জিভ বলে কথা সে কী সহজে চুপ করবে। তাই আচারকে একেবারে ত্যাগ তারা পারবে না। আর সবথেকে বড় ব্যাপার আম, আমকে তো কিছুতেই খাদ্যের বাইরে রাখা যায় না। সেই আমের আমসি, আমচূর আহা! আর তারপর ঘন সর্ষের তেলে তার নধর নধর সমাপতন, তারপর রোদের আদরে, ঝগড়ায় তার মজে যাওয়া তাই দিয়ে ঝালমুড়ি, আলুসেদ্ধ। কোনো কথা হবে না আচারে ও আচারে বাঙালির জন্মগত অধিকার নিয়ে। তারপর সেই আমের ঝাল আচার, আমসত্ত্ব বানিয়ে আচার, মিষ্টি আচার, কুল শুকিয়ে মিষ্টি আচার, সমস্ত সবজি মিশিয়ে পাঁচমিশালি আচার,চালতার আচার, কাঁচা-লঙ্কা না শুকিয়ে তার পাকা পাকা দেহকে সংরক্ষণ করে আচার, হড়বড়ি আর তার বীজকে একটু একটু বেটে বেটে আচার, জলপাইয়ের টক আচার, এচোড়-এর আচার, আর রসুনের কোয়া দিয়ে সর্ষে দিয়ে আচার, খেজুর শুকিয়ে আচার আরো যে কত কী, বলে শেষ করা যাবে না। বিভিন্ন আচারের, বিভিন্ন মসলা, বিভিন্ন ফোড়ন আর তার বৈচিত্র্যময় গন্ধ এ বাঙালির সিন্দুক ছাড়া কাকে এত ধনী করতে পারে। অন্যান্য প্রজাতির আচার খায় তা জানি, অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে বাঙালির আচার খাওয়া একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। সেই সব নিয়ম পরিষ্কার বস্ত্রে আচার বানানো, তাকে কাচের বোয়ামে আদরে রাখা, খোলা বা এটো হাতে তাকে না ধরা এসব প্রক্রিয়াকরণের গল্পেই সে যেন ছোট্ট সেলিব্রেটি খাবার।
গ্রামের মানুষ তথা দিনমজুর, চাষিরা অনেকটা পান্তা কিংবা ডাল-ভাতের সঙ্গে এক গাল আলুসেদ্ধ আর আচার পেলে যে তৃপ্তি নিয়ে খায় তা দেখলে মনে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র জায়গাতেই বোধ হয় ঈশ্বর শান্তি রচনা করেন। তবে শুধু গ্রাম কেন এ স্বাদই তো অপূর্ব গরম ডাল ভাতের সঙ্গে আমের আচারের তেল দিয়ে মাখা আলুসেদ্ধ খেয়ে দেখুন... আপনার দেহ-মন বশ্যতা মেনে নেয় কি না!
আঙুলের গা গড়িয়ে গড়িয়ে তা হাতের তালুতে এসে ধাবমান হলেই তাকে ব্যাহত না করার জন্য আমাদের সতর্ক বাঙালি জিভ খপাৎ করে তা মুখে পুরে দেয়। এভাবে আচারের সৎকার হয়। আলুর পরোটার পাসে এক চিমটি আচার পুরো মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তোলে। আমাদের জীবনের ইতিবাচক ঘটনাগুলো দ্রুত ধাবমান কারণ আমরা জীবনের তাগিদে অনেক বেশি গতিশীল ফলে ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের রাস্তা বড় হতে থাকে আর সমস্ত ইন্দ্রিয় শক্তি চায়, ক্রমবর্ধমান শক্তি। জৈবিক খিদের জন্য আমরা তো খাবই, কিন্তু স্বাদের অনুভূতি যখন কায়েমি হয়, তখন সেটা আমাদের আনন্দের কারণ হয়ে ওঠে ফলে জীবন বেঁচে থাকা সফল ভাবার উপকরণ পায়। কেবলই খিদের জন্য খেয়ে বেঁচে থাকলে আমাদের মনুষ্য জন্মের আলাদা কী বা সুখ...।
লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ।