দ্রব্যমূল্য
মুনাফার জন্য রমজান মাস আসেনি
বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে, বিশেষ করে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর কাছে রমজান সত্যিকার অর্থে কতটা তার স্বমহিমায় হাজির হয় কিংবা রমজানকে তাঁরা কতটা রমজানের মতো করে নিতে পারেন, তা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে। প্রতিবছরই দেখে আসছি, রমজান এলেই একটা হাহাকার শুরু হয় বাজার নিয়ে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী (তাঁরাও মানুষ, তাঁরাও রোজা রাখেন) হুট করে পণ্যের দাম এতটা বাড়িয়ে দেন যে বাজারে একটা আগুনে পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকেই সিন্ডিকেটের কারসাজি শুরু হয়ে যায়। রমজানে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, সেগুলোর দাম কোনো যুক্তি ছাড়াই বাড়তে থাকে। ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য, মুনাফায় ভেসে যাওয়ার জন্য কি রমজান আমাদের মাঝে হাজির হয়? পত্রিকায় এসেছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশিরভাগ মুসলিম দেশেই রমজান উপলক্ষে পণ্যের দাম কমে। কেবল বাংলাদেশই ব্যতিক্রম! এখানে কেবল বাড়ে না, দ্বিগুণ, তিন গুণ, বহুগুণ বাড়ে।
অর্থনীতিতে বলা আছে, সরবরাহ বেশি থাকলে বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাংলাদেশে যথেষ্ট সরবরাহ থাকার পরও লাগামহীন দাম বাড়ার খবর বলছে গণমাধ্যম। রমজানের অন্তত ১৫ দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, এ বছর পেঁয়াজ, রসুন, ছোলাসহ রমজানে বেশি চাহিদা থাকে এমন সব পণ্যের যথেষ্ট মজুদ আছে। অতএব, এবার দাম বৃদ্ধির কোনো প্রশ্নই আসে না। তিনি বলেছিলেন, বাজার স্থির থাকবে। যাঁরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তিনি বলেছিলেন। কিন্তু কিছুতেই তো কিছু হলো না। ব্যবসায়ীরা ঠিকই নিজেদের ইচ্ছামতো দ্রব্যের দাম বাড়িয়েছেন। বাড়তি দামে অন্য বছরের মতোই এবারও মানুষ হাঁসফাঁস করছে।
প্রতিবছর রমজান এলে যেন এই বাস্তবতা বেশি করে সামনে হাজির হয়। বাংলাদেশের বাজারকে বোঝার বোধ হয় কারো কোনো উপায় নেই। অদ্ভুত এ ব্যাপার অনেকটা মেনে নিয়েছে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ, বলা যায় মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। যে কর্তৃপক্ষের বাজারকে দেখার কথা সর্বক্ষণ, তারা বছরের অন্য সময় যেমন দেখে না, রমজানেও দেখে না। যদিও তারা বলে, তারা দেখে। দেখলে তার ফল কই? বেগুনের দাম তো ঠিকই ৫০ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। ছোলা, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, খেজুর প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত। এই দাম বৃদ্ধি কেবল এক সপ্তাহের মধ্যেই হয়েছে। স্বাভাবিক হিসাবে কখনই এক সপ্তাহে কোনো পণ্যের দাম এত বাড়ে না। তাহলে কথিত মনিটরিং কর্তারা কোথায় আছেন? তাদের এত এত হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে কী করে বাজারে দামের এমন ঘোড়া ছোটে? তাদের হাতে কি লাগাম আছে নাকি ছিঁড়ে গেছে?
এখন কেবল রমজান শুরু হলো। মাসজুড়ে যদি এ অবস্থা থাকে, তাহলে দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত মানুষরা কী করে বাজারে যাবেন আর কী করে জীবন ধারণ করবেন? দামের এই অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে গরিব খেটে খাওয়া মানুষের ওপর। রমজান সবার জন্য হলেও সবার সামর্থ্য তো সমান নয়। গরিব ও নিম্নবিত্ত মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তায় রাষ্ট্র কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? টিসিবি নামে সরকারি যে প্রতিষ্ঠান এমন সময়ে প্রান্তিক মানুষদের জন্য কম মূল্যে পণ্য বিক্রি করার কথা, তাও এবার হচ্ছে না বললেই চলে। কারণ, বিভিন্ন জেলায় ডিলাররা টিসিবির পণ্য বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, টিসিবি বাজারমূল্যের সমান মূল্যে পণ্য বিক্রি নির্ধারণ করেছে, এতে করে কেউ টিসিবির পণ্য কিনবে না। পত্রিকায় খবর এসেছে, কুষ্টিয়ায় এমন অজুহাতে কোনো ডিলারই টিসিবির পণ্য বিক্রি করছে না। কোনো কোনো জেলায় কেবল তেল ও চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকার নতুন করে কোনো চিন্তাভাবনা করছে বলে মনে হচ্ছে না। কেন? টিসিবির পণ্যে কিছুটা মূল্যছাড় দিলে তো অন্তত প্রান্তিক আয়ের মানুষেরা একটু স্বস্তি পেত। আশা করি, সরকার এ বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে। কেননা, রমজান উপলক্ষে দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি একটা অভিশাপ হয়ে আসে গরিব ও নিম্নবিত্তদের জন্য।
এই চিন্তাগুলো করা দরকার একটু বেশি করে, একটু আন্তরিকভাবে। বাজারে যারা অহেতুক দাম বাড়ায়, পর্যাপ্ত মজুদের পরও কেবল মুনাফার লোভে যারা পবিত্র রমজান মাসেও অসাধু সিন্ডিকেট গড়ে তোলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে সাধারণ মানুষ সরকারকে সাধুবাদ জানাবে। সরকার চাইলে বাজারে নিয়ন্ত্রণ আনা মোটেই অসম্ভব নয়। এরই মধ্যে অসাধু ফল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছে প্রশাসন। এটি একটি স্বস্তিজনক চিত্র। আমরা চাই, সরকার কিছু একটা করুক এবং তা মানুষের কাছে দৃশ্যমান হোক।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি।