ভোগান্তি
‘যানজটের শহর’ ঢাকা
তিলোত্তমা নগরী, মেগাসিটি কিংবা মসজিদের শহর এসবই রাজধানী ঢাকা’র সঙ্গে মিশে যাওয়া উপমা নয়। ছিল এক সময়ের বাস্তবতা। তবে সেই বাস্তবতায় ছেদ ফেলেছে যানজটের মতো মহাসমস্যা। রাত আর দিন শহরজুড়ে সব রাস্তায়ই যানজটের একই চিত্র। প্রাইভেট কার, পাবলিক বাস সবই যেন ঝিমুচ্ছে গোটা শহরেই। সাইকেল বা মোটরসাইকেল আরোহীদের মধ্যে যাদের তাড়া একটু বেশি তাদের কেউ কেউ পথচারীদের ফুটপাতকেই বেছে নেন বিকল্প সড়ক হিসেবে। অনেকে আবার ফুটপাতকে দোকানপাট বা দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছেন। এসবের ফলে ঢাকা তার সুন্দর উপমাগুলিকে ছাপিয়ে বহির্বিশ্বের কাছে এখন পরিচিতি পাচ্ছে যানজটের শহর হিসেবে।
রাজধানী হওয়ার সুবাদে ঢাকাতে মানুষের সংখ্যা যেমন বেশি, তেমনি যানবাহনের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত যানজটে আর্থিক দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ তথা গোটা দেশ।
যানজটে ঢাকা এখন চলাচলের অযোগ্য শহরে পরিণত হয়েছে। যাতে বছরে ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এক সম্মেলনে জানানো হয়, যানজটে ঢাকায় নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘন্টা। দিন দিন যানজটের পরিস্থিতি যেভাবে খারাপ হচ্ছে, তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যে আরো বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রিয় রাজধানী ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ রাস্তায় অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। শতাংশ হিসেবে যা ছাড়িয়েছে আশি’র ঘর। কোনো কোনো পরিবারের একসঙ্গে আছে তিন থেকে চারটি প্রাইভেট কার। রাস্তায় নামলে দেখা যায় একটি গাড়ির সঙ্গে থাকেন ড্রাইভার আর একজন মাত্র যাত্রী। যারা লাইসেন্স দেন বিষয়টি তাদের খতিয়ে দেখা দরকার।
যানজটের আরেকটি কারণ ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে একই পয়েন্টে আধাঘণ্টা পর্যন্ত একদিকের যানবাহন আটকে রাখে ট্রাফিক পুলিশ। অনেক সময় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। সবুজ বাতির বদলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে ট্রাফিক পুলিশের হাত।
বাস, মিনিবাস ইত্যাদি নির্দিষ্ট স্থানে না থামিয়ে চলন্ত অবস্থায় রাস্তার মাঝখানে সোজাসুজি যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়। এতে প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বিভিন্ন যানবাহন চলাচলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় এবং মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়। ঢাকার অনেক ফ্লাইওভারে ধার্যকৃত টোল মাত্রাতিরিক্ত বিবেচনায় অনেক বাস-ট্রাক চালক ফ্লাইওভার ব্যবহার না করে নিচের রাস্তা ব্যবহারের কারণে যানজট প্রায় আগের মতোই থেকে গেছে।
ঢাকার রাজপথে ও ফুটপাথের বড় একটা অংশ অবৈধ দখলদারদের অধীনে রয়েছে। এই অবৈধ দখলদারদের সঙ্গে পুলিশও জড়িত বলে অনেকের ধারণা। এটাও যানজটের একটা কারণ।
রাস্তা সংস্কার কিংবা ওয়াসা, তিতাসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলির খোড়াখুড়িতে প্রায়ই নাগরিক দুর্ভোগে পড়তে হয় ঢাকাবাসীকে। এর সঙ্গে বর্ষার মৌসুমে সৃষ্ট জলাবদ্ধতাও ভোগান্তি উপহার দেয় রাজধানী ঢাকাকে। ওই সময়ে যানবাহন চলাচলে তৈরি হয় প্রতিবন্ধকতার।
শহরের মধ্যে ট্রেন চলাচল যানজটের আরো একটি কারণ। মগবাজার, মালিবাগ, খিলগাঁও, এফডিসি, সায়েদাবাদেরর মতো ২০টি ক্রসিং পয়েন্টে প্রতিদিন প্রায় ৮০টি ট্রেন চলাচল করে। এতে যান চলাচল বন্ধ থাকে প্রায় ৬ ঘণ্টা, ফলে সৃষ্টি হয় যানজটের। এ ছাড়া অনেক ফুটপাত ভেঙে চলাচলের অযোগ্য হওয়ায় মূল রাস্তায় নেমে আসেন পথচারীরা।
ঢাকার রাস্তায় অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের নানা কর্মসূচিতেও সৃষ্টি হয় যানজট। এতে যানবাহন চলাচলে নেমে আসে বিশৃঙ্খলা। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার।
যানজটের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগে পড়েন অফিসগামী মানুষজন, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারসার্ভিস ছাড়াও জরুরি সেবাকর্মীরা। সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এজন্য নিতে হবে কার্যকর উদ্যোগ।
রাজধানী ঢাকার যানজটে অচল হচ্ছে আমাদের দেশের উন্নয়নের চাকা। বসবাসের হিসেব নিকেশে ঢাকাকে অনেকেই এখন বাদ দিচ্ছেন পছন্দের তালিকা থেকে। যদিও জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকামুখী হতেই হয় গোটা দেশের মানুষকে। সেখানে যদি যানজটই একমাত্র সমস্যা হয়ে টিকে থাকে বছরের পর বছর, সেক্ষেত্রে ভিন্নপন্থা অবলম্বনের আগে এই মহাসমস্যার আশু সমাধান খুবই জরুরি। সেজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরদারির পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে।
লেখক : সংবাদকর্মী, আরটিভি