বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি
বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু আর কত?
বৈশাখ মাসের আগে পরে বাংলাদেশে বৈশাখী ঝড় হবে, সঙ্গে বৃষ্টি বাদল হবে- এটা কেবল এ কালের বিষয় নয়, যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির এই নিয়মই দেখে আসছে বাঙালি। আমাদের চোখে আর কয় যুগই দেখলাম, মুরুব্বিরা দেখেছেন অনেক। তাঁরা বলছেন, গত সপ্তাহের কোনো কোনো দিনের মতো এমন কালো মেঘে অতীতেও বিভিন্ন সময় ছেয়েছে বাংলার আকাশ। তবে, ঢাকা শহরে দিনের আলো পুরোপুরি নিভে গিয়ে রাতের চেহারা নেওয়ার এই রূপ তারা কখনো দেখেনি। এই বিশেষ রূপের সঙ্গে, বলা যায় রূদ্ররূপের সঙ্গে, তাদের পরিচয় নেই। তাহলে কীভাবে বৈশাখ দিনে দিনে এই রূপ পেতে যাচ্ছে? আকাশ কেন এত ভয়ংকর রূপে হাজির হচ্ছে আমাদের কাছে?
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পশ্চিম দিক থেকে যে মেঘ বাংলাদেশের দিকে গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে এগিয়ে আসছে তাতে জলীয় বাষ্পের কনা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। কেন এবার জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি তা অবশ্য কেউ বলছেও না, কেউ জিজ্ঞেসও করছে না। সম্ভবত সবাই ধরেই নিয়েছে এটি জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত একটি ঘটনাই হবে। যদি তাই হয়, তবে এ বিষয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তার দরকার আছে। এত দিন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত যেসব ক্ষতির তালিকা আমরা করেছি , নিশ্চয়ই সেখানে বজ্রপাতে মৃত্যুর বিষয়টি সেভাবে উঠে আসেনি।
কালবৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি সত্যিকার অর্থেই অনেকের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ানোর বাস্তবতা এবার বোধকরি একটু বেশি করেই উপলব্ধি করছে জাতি। এর পেছনে যদি সত্যি সত্যি জলবায়ু পরিবর্তন হেতু হয়, তাহলে বাংলাদেশের এই ক্ষেত্রের বিশারদরা এবারকার বৈশাখী ঝড়ের অতি হানা আর এর ফলে মাঠে-ঘাটে কৃষকের অসহায় মৃত্যুর বিষয়টি আমলে নিবেন এবং জলবায়ু-ক্ষতির তালিকায় স্থান দিবেন বলে আশা রাখি।
প্রতিদিন বজ্রপাতে প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের নিরীহ কৃষকরা। কোথাও কোথাও শিক্ষিত ভদ্রলোকও দুয়েকজন আক্রান্ত হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিষান-কিষানিরা ধান কাটতে গিয়ে বা হাল-চাষ করতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। গত বুধবার একদিনেই মৃত্যু হয়েছে অন্তত ২০ জনের। এর মধ্যে হবিগঞ্জেই মারা গেছে ছয়জন, যাদের সবাই কৃষক। এরা সবাই বোরো ধান কাটতে মাঠে গিয়েছিল। এ বছর এক মাসেই প্রাণহানির এই সংখ্যাটা দুইশ’ ছুঁই ছুঁই। কেন? কৃষক কেন ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে বজ্রপাতের সময়ে ধানক্ষেতে ধান কাটবে? বজ্রপাত বিষয়টি তো আমাদের দেশে নতুন নয়। প্রতিবছরই এই সময়ে কমবেশি বজ্রপাত হয়। এবার না হয় একটু বেশি হচ্ছে। আমাদের কৃষক ভাইয়েরা কেন এই বিষয়টি জানবেন না যে, বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টির সময় মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বজ্রপাতের ঘটনা ঘটবে এবং তাতে প্রাণহানির আশংকা আছে? আমাদের কৃষি বিভাগ বা সরকারের সংশ্লিষ্ট অন্য বিভাগগুলো এক্ষেত্রে কী ধরনের দায়-দায়িত্ব পালন করছে বা করেছে? নাকি কৃষকের জীবন কোনো জীবন নয়?
আমরা পরিবহনের গতির প্রতিযোগিতায় হাত হারানো রাজীবের মৃত্যুকে দুর্ঘটনার জায়গায় হত্যা বলার দাবি করছি, কালবৈশাখীর একেবারে উন্মত্ত সময়ে কৃষককে ধানক্ষেতে ধান কাটতে পাঠানো বা যেতে বারণ না করার ফলে যে মৃত্যু, তাকে কী বলব- শুধুই মৃত্যু নাকি অবহেলা জনিত হত্যাকাণ্ড? বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মরে যাওয়া সব কৃষকেরই অধিকার ছিল তাদের জীবন কোথায় বিপন্ন– তা জানার; রাষ্ট্র তাদের এ খবর জানানোর কথা। কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এই মৌসুমে বজ্রপাতের আঘাতে মৃত্যুর হাত থেকে কৃষকদের বাঁচাতে তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে- তা জানা জরুরি। আদৌ কি কোনো পদক্ষেপ তারা নিয়েছে? সতর্ক করা বা সচেতনতা সৃষ্টিতে কোনো প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে? লোকালয়ে মাইকিং বা অন্য কোনো উপায়ে কৃষককে সতর্ক করা হয়েছে? যদি না করা হয়, তাহলে আমি বলব, এটি পরিষ্কার অবহেলা; এটি একটি অপরাধ। মাঠে কৃষকের মৃত্যু সরকারি অবহেলাতেই হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বজ্রপাতকে সম্প্রতি দুর্যোগ হিসেবে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এই দুর্যোগ থেকে জনগণকে, বিশেষ করে মাঠের কৃষককে বেঘোরে মরা থেকে বাঁচাতে, তাদের জীবনের হঠাৎ ‘যতি’ পড়া থেকে বাঁচাতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা তদন্ত করে বের করার দাবি রাখে। একদিন যদি ২০ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়, পরের দিন, তার পরের দিন কিংবা তারও পরের দিন কেন একই কারণে মানুষ মরবে? কেন তারা এই প্রাণহানির বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সংকেত পাবে না, সহযোগিতা পাবে না? এসব বিষয় সরকারের অনেকের কাছে খুব ছোট, মামুলি বিষয় মনে হতে পারে। তবে, সবাইকে মনে রাখতে হবে, কোনো প্রাণই তুচ্ছ নয়, কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এই দেশে কৃষকের প্রাণ তো নয়ই। ধান কাটতে গিয়ে তাদের জীবনে যতি পড়ে যাওয়াটা মোটেও ‘এটা তো হতেই পারে’ ধরনের বিষয় নয়।
অনেক প্রাণ তো ঝরে গেল। আগামীর যেকোনো বজ্রপাতের হাত থেকে আমাদের কৃষক ভাইদের রক্ষায় এখুনি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হোক। আজই নেওয়া হোক। আজ ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে, কাল যেন আর শুনতে না হয় ধান কাটতে গিয়ে জীবন হারাতে হলো কোনো কৃষককে। এটা নেহাতই দুর্ঘটনা নয়। প্রয়োজনে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বা যেদিন যেদিন বজ্রসহ বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে সেদিন কৃষককে মাঠে যাওয়া থেকে জোর করে হলেও নিবৃত্ত করতে হবে। আবহাওয়া অফিস, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস এবং স্থানীয় ইউপি চেয়রম্যান-মেম্বাররা যৌথভাবে প্রচেষ্টা নিলে এই কাজ সম্ভব। এভাবে বেঘোরে আর মরতে দেওয়া যায় না কৃষকদের। তারা না বুঝলেও রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি