বং এক্সপ্রেস
দুপুরবেলার কলেজস্ট্রিট
ট্রামের এককালীন আওয়াজ ফুরিয়ে গেলেও লাইনের পাতে তার স্পন্দনরা লুকিয়ে থাকে এখানে। আর ঐ যে কিং অ্যান্ড কোং-এর হোমিওপ্যাথির দরজা তার উল্টোদিকে মাথা ভাঙা ডাবগুলো উল্টেপাল্টে হেসে এ-ওর গায়ে গড়াগড়ি খায়... এই বৈশাখের আগমনী রোদে আপনি সুতির জামা পড়ে ফুটের এদিক থেকে ওদিক হেঁটে বেড়ালেই বুঝবেন প্রাচীন পৃথিবীর সাক্ষী হয়ে উঠছেন। আসলে একটা সময় থেকে আরেকটা সময়ের মাঝে কিছু বিপন্ন সময় থাকে বিপন্ন প্রজাতির মতো যাদের দিয়ে সময়ের সংকেত ও ইতিহাস আঁচ করা যায়। এখানে সেটা পূর্ণমাত্রায় পাবেন। একটি বিদেশি রেস্তোরাঁর অনতিদূরে এক কুলি ডাল-ভাত খেয়ে চোখ বন্ধ করে প্রাণকে স্পষ্ট করছে। সুতো ঝোলা লাইটার থেকে সিগারেট জ্বালিয়ে একজন ক্ষুধার্ত ধোঁয়া দিয়ে পেট ভর্তি করে এখানে।
হাওড়ার দিক থেকে যখন ফলের বাজারের মোড় আসে দেখি, এক সুদর্শন যুবা কাটা ফলের ওপরে ধূপ দিয়ে গোঁফে হাত দিয়ে বাসের জানালা দেখছে। বোধ হয় ফলের সুবাস ওকে শিখিয়েছে ফুটপাত থেকে জানালায় রাখা চোখ দিয়ে দু-এক মিনিটের স্বপ্নিল প্রেম করা যায়। অজস্র জনজীবন আর বিপজ্জনক বাড়ির সতর্কতা নিয়ে একেকটা কলপাড়ে জল পড়ে অবিরাম। ছোট মেয়েগুলো হোটেলের বাসন মাজে আর জলের শব্দ পরিবর্তন বুঝে ড্রাম ভরে নেয়। এখানে কলরা ক্রমাগত চলে। ব্যস্ত-সমস্ত ক্লান্ত রাস্তা ফাঁকে-ফোঁকে এভাবে জলে ভিজে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। বাসের কন্ডাক্টর ফুলওয়ালিকে বলে আরো একটা পোঁটলা ওঠালে আরো পাঁচ টাকা, ফুলওয়ালি নেমে যায় কখনো বা উঠেও পড়ে। এই ফুল বড় বাড়ির মেয়ে ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়ে মুছে ধুয়ে সাজিতে সাজাবে। ঠাকুরের পায়ে যাবে যে ফুল তার আগে বহুবার সে মানুষের পা ছুঁয়ে বাজারে এসেছে!
স্যাঁতসেঁতে এঁদো গলি তবু তো কলেজপাড়া বই ধরে বসে আছে যেন মরমি যুগের সভ্যতা। দুধারে দুই ফুটে, দিদি অনার্সের বই, মানে বই। কী বই লাগবে ও ম্যাডাম! বই নয় খই লাগে, লাগে দুটো মুড়ি—বই বয়ে যারা সব ভ্যানের বুকেতে শোয় ওরা জানে বোঝা—তবু বয় বই। বোঝা আর পেট আদানের প্রদানে বেঁচে থাকে দেহ। আমরা বই কিনি।
বইয়ের ফাঁকে নতুনের গন্ধ! শুধু কী গন্ধ তারা! কত কত হাত হয়ে গল্পের বোঝা বয়ে আমার টেবিলে এসে বসেছে। আহা আমি তাকে বই বলি, কলেজস্ট্রিটের থেকে আনা বই। এ পাশে কাজল পড়া, কপালে টিপের ছোঁয়া আর রূপোর হার—কবির প্রেমিকা তবে এখানেই আসে। আড়চোখে দেখে নেয় পথের বাঁ দিকে কারা যেন কলেজপড়ুয়া সব যুবক-যুবতী!
এখানে আকাশ তবে কখনো মায়াবী হয়ে বসন্তবিলাপ শেখে। গলির কোনায় বসে গামছা ভেজা রিকশাওয়ালা ঘুমের দেশে ওড়ে। আর পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বালিশ বানানোর আকুতি। দুপুরের এ মাথা থেকে ও মাথা ঘাড় ব্যাঁকা ভ্যান বাঙালির বই বয়ে নিয়ে যায়। বই নিয়ে এদেশ-ওদেশ—প্যারামাউন্ট শরবত ধরে কুহক জাগায়। দুপুরে খিদের পেট ঝুরঝুর আলুভাজা, আমের চাটনি—সে এক আদর্শ হিন্দু হোটেল। এদিক-ওদিক চা উথলে ওঠে—মাটির ভাঁড়েরা এসে একতা বাড়ায়। আমাদের পঞ্চভূতের বেমালুম বাঙালি রসেবশে বড় হওয়া দেহ উনুনে আঁচ ধরাতে দেখলে বইরা সব খিদের বাহানা খোঁজে, পাগলের বালিকা বধূ কোনো এক পুরোনো কাগজে মুড়ি নেড়ে খায়—খবর, শব্দ ও মুড়ি পেটে পেটে কলেজপাড়ার জন্ম দেয়। বিশুদ্ধ ট্রামলাইনে এসে জীবনানন্দ ভেসে ওঠে, কেঁপে ওঠে বাতাসে সে কবিতার শরীর। আমাদের মোহময়ী কলেজস্ট্রিটের দুপুর জলে ভিজে, ঘাম শুষে, নতুনের বই মাখা যেন নববধূ বাংলার গল্প তার এত রূপ যে বাংলার হারানো সুতোগুলো এখানে বুনে বুনে বাঙালির স্বপ্ন মেটায়। এখানে বই-এর পাহাড়, এখানে কাগজের জন্মলগ্ন শুরু, শরীরে ব্যুৎপত্তি হয়ে সে বই এর রাজা। গরমে, নরমে কাঁচা তার আগমনী দেহ। লোকে চোখে চোখে দেখে, ভাঁজেতে মুখ গুঁজে শান্তির সুবাস বানায়। তার নাম বই, দেহের আহারে-বিহারে সে স্মৃতির ঈশ্বর ,তাকে ধরে পৃথিবীর পাঠ করি শুরু।
লেখক : কবি, পশ্চিমবঙ্গ