পাহাড়ে অসন্তোষ
নানিয়ারচর নিয়ন্ত্রণই মূল কারণ!
রাঙামাটি শহরে থেকে উত্তরে অবস্থিত ছোট উপজেলা নানিয়ারচরের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার । এর আয়তন ৩৯৩ দশমিক ৬৮ বর্গকিলোমিটার বা ১৪৯ বর্গমাইল। উপজেলার উত্তরে খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলা, দক্ষিণে রাঙামাটি সদর, পূর্বে লংগদু উপজেলা ও বরকল উপজেলা, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা।
আয়তন অনুসারে নানিয়ারচর রাঙামাটি উপজেলার ষষ্ঠ বৃহত্তম উপজেলা। কাপ্তাই হ্রদ বেষ্টিত সবুজ পাহাড়ঘেরা এই উপজেলার নিকটবর্তী বুড়িঘাটেই ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল শহীদ হয়েছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে এই উপজেলার জনসংখ্যা ৪২ হাজার ৯৬৫ জন। ১৯৮৩ সালের ১ আগস্ট উপজেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এই ছোট্ট উপজেলাটির সাবেক্ষং,নানিয়ারচর,বুড়িঘাট ও ঘিলাছড়ি নামের চারটি ইউনিয়নে বিভক্ত। এই উপজেলাটি প্রথম দেশব্যাপী আলোচনায় আসে ১৯৯৩ সালের ১৭ নভেম্বর। এদিন নানিয়ারচর বাজারে তৎকালীন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) নেতাদের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের বাগবিতণ্ডা হয়। এরপর স্থানীয় বাজারের লোকদের সঙ্গে পিসিপি নেতাদের বিতণ্ডা সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রূপ নেয়। যাতে নিহত হন বেশ কয়েকজন পাহাড়ি। দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসে ছোট্ট এই উপজেলাটি।
যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে উপজেলাটি
১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সাক্ষরিত হলে সেই সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে চুক্তির বিরোধিতা করে জন্ম হয় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। রাঙামাটির প্রতিটি উপজেলা থেকে প্রত্যন্ত এলাকায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস ১৯৯৭ সালের পর থেকে দাপিয়ে বেড়ালেও নানিয়ারচরই একমাত্র উপজেলা যেখানে গত ১৮ বছরেও পা ফেলতে পারেনি সংগঠনটি। এই উপজেলাটিতে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণ এতটাই শক্তিশালি ছিল যে, খোদ সন্তু লারমাও এই উপজেলায় যেতে পারেননি কখনই,বরং এই উপজেলা সড়কেই সন্তু লারমার গাড়িবহরে দুই দফা হামলাও হয়।
রাঙামাটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও জনসংহতি সমিতির নেতা ঊষাতন তালুকদার এই নানিয়ারচর উপজেলায় সামান্য কিছু ভোট পান এবং এখানে তাদের কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমও নেই। ফলে খাগড়াছড়ির সীমান্তবর্তী এই উপজেলাটি ইউপিডিএফের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে। এখানকার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি)চেয়ারম্যান কিংবা সদস্য,উপজেলা চেয়ারম্যান সবই নির্বাচিত হয়েছে ইউপিডিএফের ইচ্ছায় ও ইশারায়। নানিয়াচরকে বলা হয় ইউপিডিএফের সুরক্ষিত ও সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি।
যেভাবে উল্টে যেতে থাকে নিয়ন্ত্রণ
২০১০ সালে জনসংহতি সমিতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাতিন্দ্রলাল চাকমা পেলে, সুধাসিন্ধু খীসা ও শক্তিমান চাকমা মিলে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) নামে নতুন রাজনৈতিক দল। যেহেতু দলটি সন্তু লারমার কাছ থেকে সরে গিয়ে গঠিত হয়েছে,সঙ্গত কারণেই ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ এমন নীতির কারণে ইউপিডিএফের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তাদের। এই সখ্যতার অংশ হিসেবে দুই দল একত্রিত হয়ে মোকাবিলা করে শক্তিশালী জেএসএসকে (সন্তু লারমা)। পাল্টাপাল্টি হামলায় নিহত হয় উভয় পক্ষের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী। জেএসএস প্রকাশ্যেই এই দুই দলকে ‘একে অপরের পরিপূরক’ হিসেবেই তুলে ধরে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে।
কিন্তু জেএসএস-এমএন লারমা ও ইউপিডিএফের এই প্রেম কিংবা ভালোবাসা কিংবা দহরম-মহরমে বড় ধরনের চোট লাগে সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। যখন প্রথমত ‘ফ্রেন্ডলি গেম’ হিসেবেই অতি আত্মবিশ্বাসী ইউপিডিএফ নির্বাচনের মাঠে প্রার্থী হিসেবে নামতে দেয় নিজেদেরই তখনকার মিত্র ও বন্ধু শক্তিমান চাকমাকে। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। নিজেদের প্রবল আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও সেই নির্বাচনে স্থানীয় হিসেবে বেশিমাত্রায় পরিচিত ও জনপ্রিয় শক্তিমানের কাছে হেরে যায় ইউপিডিএফের প্রার্থী সুশীল জীবন চাকমা। পরাজয়ে ধাক্কা কাটাতে কাটাতে যেমন সময় লাগে ইউপিডিএফের, তেমনি ধাক্কা কাটিয়ে উঠার আগেই তারা দেখতে পায়, নিজেদের শক্ত ঘাঁটিতেই ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে ইউপিডিএফ। নিজের মেধা, যোগ্যতা আর দূরদর্শীতার কারণে শক্তিমান চাকমা নিজের দল জেএসএস-এমএন লারমাকে নানিয়ারচরে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে শুরু করেন। ফলে ২০১৬ সালে নিজেদের সবচেয়ে সুরক্ষিত ঘাঁটি থেকেই উৎখাত হয়ে পড়ে ইউপিডিএফ। গত এক বছরে নানিয়ারচর সদরে প্রবেশও করতে পারেনি তারা,পালন করতে পারেনি কোনো কর্মসূচিও। ইউপিডিএফ নানিয়ারচর হয়ে ওঠে জেএসএস-এমএন লারমার নানিয়ারচর। বিষয়টি মানতে পারছিল না ইউপিডিএফ। এই সময়েই মধ্যেই ঘটে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ইউপিডিএফ-জনসংহতি ঐক্য বনাম দুইপক্ষের বিদ্রোহীরা!
২০১৬ সালে পার্বত্য রাজনীতিতে একটি বড় মেরুকরণের ঘটনা ঘটে। সন্তু লারমার জনসংহতি সমিতির সঙ্গে চিরশত্রু প্রসিত খীসার ইউপিডিএফের মধ্যে একটি বিরল রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই দুই সংগঠন পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত এক হাজার নেতাকর্মী নিহত হলেও এই বিরল সমঝোতার পর আর কোনো সংঘাত হয়নি দুইপক্ষের। এই নতুন মেরুকরণের ফলে ইউপিডিএফের সঙ্গে তার পুরোনো বন্ধু জেএসএস-এমএন লারমার দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। এরই মধ্যে আবার ইউপিডিএফের বিদ্রোহী একটি অংশ তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামে পৃথক আরেকটি দল গঠন করে। নতুন এই দলটির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে ইউপিডিএফের সম্পর্কের টানাপোড়েনে থাকা জেএসএস এমএন লারমার পক্ষের। ফলে তৈরি হয় নয়া মেরুকরণ। এই মেরুকরণে ইউপিডিএফের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনায় গত তিন মাসে নিহত হয় অন্তত সাতজন নেতাকর্মী। এদের মধ্যে আছেন দলটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা মিঠুন চাকমাও। ফলে একদিকে নানিয়ারচরে নিয়ন্ত্রণ হারানোর কারণে শক্তিমান চাকমার ওপর ক্ষোভ আর একের পর এক নেতাকর্মী হত্যার জন্য তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার ওপর ক্ষোভ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় ইউপিডিএফের।
এর মধ্যে গত মার্চ মাসে ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দুই শীর্ষ নেত্রীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। প্রায় ৩২ দিন পর এই দুই নেত্রী মুক্তি পেলেও এই ঘটনায় তপনজ্যোতি চাকমা বর্মার ওপর চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ইউপিডিএফ। সঙ্গতকারণেই শক্তিমান চাকমা ও তপনজ্যোতি চাকমা হয়ে ওঠে ইউপিডিএফের মূল এবং একমাত্র টার্গেট !
কী হবে নানিয়ারচরে
মাত্র দুদিন আগে যে নানিয়ারচরে যেতেই পারত না ইউপিডিএফের নেতাকর্মী বা সশস্ত্র ক্যাডাররা, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে বাধার প্রাচীর হয়ে থাকা উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেএসএস-এমএন লারমার অন্যতম শীর্ষ নেতা শক্তিমান চাকমাকে গুলি করে করে হত্যা এবং তাঁর দাহক্রিয়ায় অংশ নিতে গিয়ে সশস্ত্র হামলায় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপনজ্যোতি চাকমার মৃত্যুর পর আবার সেখানে ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে বিষয়টিকে খুব সহজ বলে মনে করছেন না পার্বত্য রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে কাছ দেখা পর্যবেক্ষকরা। তাদের ধারণা, আসছে দিনগুলোতে আরো বড় ধরনের মেরুকরণ ঘটতে যাচ্ছে।
বলা হয়ে থাকে,নানিয়ারচর উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এই উপজেলায় যার নিয়ন্ত্রণ থাকে সে পাশের খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফলে নানিয়াচরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া বা নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হওয়ার ওপর নির্ভর করছে মহালছড়ির ভাগ্যও।
লেখক : রাঙামাটি প্রতিনিধি