রোহিঙ্গা সংকট
জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলের সফরে কিছু হবে কি?
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফর করছে জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যসহ নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা। এই দলে আছে স্থায়ী সদস্য দেশ চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য। এ ছাড়া আছে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য বলিভিয়া, আইভরি কোস্ট, গিনি, ইথিওপিয়া, কাজাখস্তান, কুয়েত, নেদারল্যান্ডস, পেরু, পোল্যান্ড ও সুইডেন। শুধু ১৫টি স্থায়ী সদস্য দেশই নয়, সঙ্গে আছে আরো ছয়টি দেশের প্রতিনিধিও (বার্বাডোজ, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, মিসর, জর্ডান, সুইজারল্যান্ড)। উদ্দেশ্য, বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খোঁজা। অভিযুক্ত দেশ মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বিতাড়িত নাগরিকদের সসম্মানে নিরাপদে নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার উপায় বের করার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে জাতিসংঘের ২১টি দেশের প্রতিনিধিদের এই উপস্থিতি।
আপাতদৃষ্টিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। শুরু থেকেই দায় স্বীকার না করার কৌশল নেয় মিয়ানমার। উপেক্ষা করে আন্তর্জাতিক চাপ। অস্বীকার করে নিপীড়নের দায়। পরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নানা নাটক সাজানোর চেষ্টা চালায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আরসার ‘হামলা’, আরসা নেতার ‘ভিডিও বার্তা’, অভিযুক্ত কয়েকজন সেনার ‘বিচার’, কয়েকজন রোহিঙ্গার মিয়ানমারে ‘ফেরত যাওয়া’। এসবের কোনোটাই নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত করা যায়নি। তা ছাড়া প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বাস্তুচ্যুতির পরিপ্রেক্ষিতে এগুলো নিতান্তই ঠুনকো।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক চাপের পরিপ্রেক্ষিতে নানা উদ্যোগ নিয়েও টালবাহানার শেষ নেই মিয়ানমারের। গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় তীব্র সমালোচনার মুখে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা উ থুয়াং তুন জানান, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে করা চুক্তি অনুসারে হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। সেই প্রতিশ্রুতির সাত মাস পরেও এই সংকট সমাধানে মিয়ানমারের আন্তরিকতার ছিটেফোঁটারও দেখা মেলেনি।
অক্টোবরে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে মিয়ানমার। যেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দুদেশ সহযোগিতায় সম্মত হয়। এ ছাড়া মিয়ানমার অঙ্গীকার করে, আর কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসবে না। নভেম্বরের ২৩ তারিখে একটি চুক্তি হয়। সে সময় অবশ্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা চুক্তিতে তৃতীয় পক্ষ না রাখা, নিরাপত্তাসহ স্থিতিশীল পরিবেশ নিশ্চিত করার প্রসঙ্গ না থাকায় উদ্যোগ ফলপ্রসূ হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এরপরও বেশ কয়েকবার নিজেদের কথা রাখেনি মিয়ানমার। শর্ত শুধু ১৯৯২ এর চুক্তির আলোকে ফেরত নেওয়া হবে, এতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এরপর ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র (চীন ও রাশিয়া ব্যতীত)।
চুক্তি অনুসারে এ ২২ জানুয়ারি থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে এসে বাড়তি শর্ত জুড়ে দেয় মিয়ানমার। ১৬ জানুয়ারি জানায়, পরিবারভিত্তিক ডাটাবেজ করতে হবে। বাংলাদেশ তাতেও সম্মতি দেয়। পাসপোর্ট বিভাগ সব রোহিঙ্গা নাগরিকের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করলেও সেটা পরিবারভিত্তিক ছিল না। এর আগে শর্ত ছিল নাগরিকত্বের প্রমাণ থাকা সাপেক্ষে ফিরিয়ে নেওয়া হবে (১৫ অক্টোবর ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব আইন জারির মাধ্যমে নাগরিকত্ব হারায় রোহিঙ্গারা)।
মিয়ানমারের এই ঔদ্ধত্যের পেছনে রসদ জুগিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীন। তাদের ভেটো দেওয়ায় জাতিসংঘে একাধিকবার আটকে গেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত প্রস্তাব।
রাশিয়া ও চীন বাদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সব দেশ রোহিঙ্গা নিপীড়নকে পদ্ধতিগত গণহত্যা বলে মন্তব্য করেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রধান একে জাতিগত নিধনের টেক্সটবুক উদাহরণ বলেছেন।
বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশের উদ্বেগ, নিন্দা, প্রতিবাদ, অনুরোধ সবকিছুকে থোড়াই কেয়ার করছে মিয়ানমার। সবার অনুযোগেও কানে তুলো দেওয়া রাশিয়া ও চীনসহ জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের এই সফর তাই গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের জন্য। এতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বাড়ল, সন্দেহ নেই। শরণার্থীদের দুরবস্থা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের পর, প্রতিনিধিদলের মিয়ানমার সফর এই ইস্যুতে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পদক্ষেপ। এটি শুধু জাতিসংঘের সভায় নিন্দা জানানো কিংবা প্রস্তাব উত্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকবে না কিংবা নেই, তা বলা বাহুল্য। তাই আমরা আশাবাদী।
এ সফরেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে; এতটা আশা করা যায় না। সহসা কাটবে অচলাবস্থা, সে আশাও বাড়াবাড়ি। তবে সমাধানের দ্বার খোলার দারুণ এক সম্ভাবনার কাছাকাছি আসা সম্ভব হয়েছে, তা বলাই যায়। জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের সব দেশের প্রতিনিধি একসঙ্গে কোনো দেশ সফর কিংবা কোনো এক ইস্যুতে সরব হওয়া ব্যতিক্রম ও বিরল ঘটনা। দেখার বিষয়, সুযোগটা কতটা সাফল্যে পরিণত করতে পারে বাংলাদেশ। বলা যায়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের এযাবৎকালের সেরা দৃশ্যমান কূটনৈতিক উদ্যোগ। আশা করি, রোহিঙ্গারা নিরাপদে সসম্মানে নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরির চাবিকাঠির ভূমিকা রাখবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের এই সফর। ঘুচবে অন্ধকার। দেখার বিষয়, সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ।
লেখক : সাংবাদিক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর