অভিমত
মিডিয়া কি পুলিশের শত্রু?
বাংলা টিভির দুই সংবাদকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। মানববন্ধন হয়েছে ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ের সামনে। তবে এখানেই কি শেষ? ঘটনাটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানার কারণে কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করছি।
সোমবার ছিল ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। দুপুর ১টার দিকে নয়াপল্টন এলাকায় মিছিল করা হবে, জানানো হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে। আমার অ্যাসাইমেন্ট ছিল বিএনপির ওই কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করার। আমরা কয়েকটি মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অবস্থান করছিলাম। দুপুর দেড়টার দিকে খবর এলো পুরানা পল্টন এলাকায় মিছিলের চেষ্টাকালে পুলিশের বাধা। আর সেখান থেকেই বাংলা টিভির রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসনকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংবাদটি শুনেই খুব একটা ধাক্কা খেলাম। বাংলা টিভির রিপোর্টার আরমান কায়সারের মুখটি মনে পড়লে। সাংবাদিকতায় নবীন, নরম স্বভাবের এ ছেলেটি এবং তার ক্যামেরাম্যান কী এমন অপরাধ করল যে আটক করা হলো? তারা কি মিছিলে পিকেটিং করছিল পুলিশের ওপর? আর বিএনপি কি নিষিদ্ধ কোনো রাজনৈতিক দল? পূর্বঘোষিত রাজনৈতিক কর্মসূচির সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া কি আইনত অপরাধ? এমনই নানা প্রশ্ন মাথায় আসছিল।
যাই হোক, আমাদের তখন প্রথম চেষ্টা ঘটনার বিস্তারিত জানা এবং দুই সহকর্মীর পাশে দাঁড়ানো। কয়েকজন সংবাদকর্মী তৎক্ষণাৎ পল্টন থানায় যায়। আমরা যখন থানায় পৌঁছাই তখন তিনজন পুলিশ সদস্য ৪০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ব্যক্তিকে অনেকটা টেনেহিঁচড়ে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে থানার ভেতরে প্রবেশ করছেন। তার পা দিয়ে রক্ত পড়ছে, হাঁটার মতো কোনো অবস্থা নেই। ওই ব্যক্তি চিৎকার করছেন একটু পানির জন্য। একসঙ্গে এত গণমাধ্যমকর্মী দেখে পুলিশ সদস্যরা তাঁকে দ্রুত টেনে নিয়ে একটি বড় কক্ষে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিলেন। এক পুলিশ সদস্যের কাছে জানতে চাইলাম আটক ব্যক্তি ছিনতাইকারী কি না? সম্ভবত উনি এএসআই বা এসআই সমপর্যায়ের কেউ হবেন। আমার মনে হয়েছিল, ছিনতাইকারী হলে গণধোলায় খাওয়ার পর হয়তো ওই অবস্থা। কিছুটা খারাপ লাগা এবং সাংবাদিকসুলভ কৌতুহল থেকেই সহজ একটি প্রশ্নের উত্তর পুলিশ কর্মকর্তা যে ভাষায় দিলেন, তাতে মনে হলো ওই মিছিল থেকেই তাকে আটক করে নিয়ে আসা হয়েছে। আর এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়াটাও যেন অপরাধ। তিনি কিছুটা উত্তেজিত ভাব দেখালেন। অবশ্য আমাদের অন্য সহকর্মীরা প্রতিবাদ করলেন। তাতে অবশ্য ওই পুলিশ সদস্য নমনীয় হলেন না। সকলেই জানেন, পুলিশের আচরণ এমনই!
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কক্ষে প্রবেশ করতেই দেখি বাংলা টিভির রিপোর্টার এবং ক্যামেরাম্যান দাঁড়িয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করছেন। আমার এতগুলো গণমাধ্যমকর্মী একসঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করায় চেয়ারে বসা পুলিশ কর্মকর্তা কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন। সেইসঙ্গে সাদা পোশাকে থাকা দুই পুলিশ সদস্যও। আমাদের সিনিয়র এক সাংবাদিকসহ দুজন ভেতরে থাকলেন, আমরা সবাই বাইরে চলে এলাম। চেয়ারে বসা সেই পুলিশ সদস্যকে প্রথমে আমরা পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনে করেছিলাম। কিন্তু একটু পরেই জানলাম তিনিই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা টিভির রিপোর্টার আরমান কায়সার ও ক্যামেরাপারসন মানিকের ওপর চড়াও হওয়া পুলিশের মতিঝিল জোনের উপ-কমিশনার আনোয়ার হোসেন।
উপকমিশানার আনোয়ার হোসেনের সেই সময়ের কথাগুলো ছিল খুবই আক্রমনাত্মক। উনার দাবি ক্যামেরাম্যান কেন তার লাঠি ধরল? এর মাধ্যমে নাকি তার সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে! আপনি পুলিশ বলে একজন সংবাদকর্মীর গলা টিপে ধরতে পারবেন, শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে যাবেন, লাঠি দিয়ে মারতে উদ্যত হবেন এবং আটক করে থানায় নিয়ে আসবেন, আর কেউ যদি আত্মরক্ষার জন্য লাঠি চেপে ধরেন, সেটি সরকারি কাজে বাধা! লাঠি কি ওই ক্যামেরাম্যান এমনি এমনি ধরতে যাবে? নিশ্চয় পুলিশ প্রহারের জন্যই লাঠি ব্যবহার করছিলো, সেজন্যই লাঠি ধরে নিজেকে রক্ষা করেছেন ওই সংবাদকর্মী। ছবি অন্তত তাই বলছে।
যাই হোক, সেসময় রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যানকে সরি বলেই থানা থেকে ছাড়া পেতে হয়েছিল। আর আমরা এতগুলো গণমাধ্যমে সাংবাদিকরা যদি ছুটে না যেতাম তা হলে হয়তো সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে কিংবা এর সঙ্গে মাদক যুক্ত করে মামলা দিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হতো। প্রশ্ন হলো সংবাদকর্মীরা কি পুলিশের শত্রু? শুধু সংবাদকর্মী কেন, সাধারণ জনগণ কি পুলিশের শত্রু? কেন এখনো বাংলাদেশের পুলিশ সাধারণ মানুষের বন্ধু হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেনি?
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।