বাংলা নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা
সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি বাঙালির রাজনৈতিক আন্দোলনেও পহেলা বৈশাখ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে গ্রাম, গঞ্জ, শহর, বন্দর সাংস্কৃতিক উৎসবে মেতে ওঠে। বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনার বটমূলে ছায়ানট, চারুকলা ইনস্টিটিউট, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা, স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। তারা লোকজ চিত্রকলা আঁকে, পশু-পাখির মুখোশ তৈরি করে নানা সাজে নানা ভাবে বৈচিত্র্যময় বৈশাখী র্যালিতে অংশ নিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ সঙ্গীতানুষ্ঠান ও জাতীয় চেতনামূলক আলোচনা সভার মাধ্যমে তারা নববর্ষকে বরণ করে নেয়। সকালে পান্তাভাত-ইলিশ খাওয়া, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কবিতা ও ছড়া পাঠের আসর, বইমেলার আয়োজন, সারাদেশে সময়ভেদে নানা বর্ণের ছোট-বড় মেলা, মেলা থেকে সাংসারিক দ্রব্যাদি কেনা, কুটির শিল্পজাত দ্রব্যের সমাগম, আনন্দের লক্ষ্যে বিভিন্ন খেলাধূলার আয়োজন, পুতুলনাচ, সার্কাস, চট্টগ্রামের বলীখেলা প্রভৃতিই বিনোদনের উপকরণ হিসেবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পায়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকগান ও লোকনর্তকদের উপস্থিতি মেলায় লক্ষ করা যায়। মেলায় গম্ভীরা গান, গাজীর গান, আলকাপ গানসহ বিভিন্ন ধরনের লোকসঙ্গীত, বাউল-মারফতি-মুর্শিদি-ভাটিয়ালি ইত্যাদি আঞ্চলিক গান পরিবেশন করতে দেখা যায়।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বৈশাখী মেলা লোক ও কারুপণ্যের সমাহারের পাশাপাশি লোকসাহিত্যের বিকাশ ও প্রদর্শনে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। পূর্বে রাজা-জমিদার, তালুকদার, বিত্তশালীগণ বৈশাখী মেলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং নিজেদের স্বার্থে সার্কাস, যাত্রাপালা, লোকসঙ্গীত প্রভৃতির আয়োজন করতেন। এর ফলে প্রত্যেক এলাকায় জনজীবন ঘনিষ্ঠ নানা ধারার সংস্কৃতির বিকাশ ঘটত। বর্তমানে নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত বৈশাখী মেলা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রায়োগিক ফোকলোর ভিত্তিক সাংস্কৃতিক উপাদানের সমাহার ব্যাপক আকারে লক্ষ করা যায়। শহর-গ্রাম সর্বত্র এসময় নানান ধরনের লোকসঙ্গীত ও লোকনাট্য পরিবেশিত হয়ে থাকে। দেখা যায়, বাংলা নববর্ষ কেবল সাংস্কৃতিক উৎসবই নয়, একই সঙ্গে তা অর্থনৈতিক আর সামাজিক উৎসবও। বস্তুত যেসব ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক উপাদান আমাদের জনগোষ্ঠীকে বাঙালি পরিচয়ে পরিচিতি দান করেছে, বাংলা নববর্ষ তাদের মধ্যে প্রধানতম।
বাংলা নববর্ষের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের লোকশিল্পের সংযোগ যেন জীবনেরই সংযোগ। বৈশাখী মেলা উপলক্ষে শিল্পপণ্যের উপকরণ প্রস্তুতকরণ, উৎপাদন, নান্দনিক রূপদান, প্রদর্শন, বিপণন প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বিস্তীর্ণ কর্মযজ্ঞ। বিভিন্ন বৃত্তিজীবী লোকশিল্পী সম্প্রদায় নববর্ষকে সামনে রেখেই দৈনন্দিন ব্যবহার ও চিত্তবিনোদনের উপযোগী এসব শিল্পসম্ভার তৈরি করেন। এসব শিল্পদ্রব্য সাধারণত বৈশাখী মেলার জন্য প্রস্তুত করা হয়ে থাকলেও বছরের অন্যান্য সময়েও প্রচুর বিক্রি হয়ে থাকে। বৈশাখী মেলা উপলক্ষে কুমোরেরা শিশু-কিশোরদের মন হরণের জন্য মাটির তৈরিঘোড়া, গরু, হরিণ, পুতুল প্রভৃতি তৈরি করে। মেলায় প্রদর্শিত শখের হাঁড়িসহ সব দৃষ্টি নন্দিত শিল্পপণ্য শিল্পীরা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ বিভিন্ন রঙের তুলির স্পর্শে অসামান্য শৈল্পিক অভিনবত্ব দেয়। এসব দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মই কেবল নয়, কামারেরা আসেন লোহার তৈরি নানান উপকরণাদি নিয়ে, দারুশিল্পীরা আসেন খাট, পালঙ্ক, টেবিল, আলনা প্রভৃতি শিল্পসামগ্রী নিয়ে। কোনো কোনো দারুশিল্পী আবার শিশুদের খেলার সামগ্রী যেমন- লাটিম, ছোটো নৌকা, পুতুল, গাড়ি প্রভৃতি পসরা সাজিয়ে বসেন। এ ছাড়া অঞ্চল বিশেষে বাঁশ ও বেতের শিল্প দ্রব্যও বৈশাখী মেলার অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠে। এ ছাড়া, লোকশিল্প সম্ভারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মালাকারদের এবং গ্রামের মহিলাদের হাতের তৈরি বিভিন্ন শিল্পকর্ম। নাগরিক জীবনের পরিসরেও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে লোকশিল্পের নানামুখী উপযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। নববর্ষের প্রভাতে আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা লোকশিল্পের উপস্থিতি ছাড়া কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। এদিনে নগরে আয়োজিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জাতেও লোকশিল্পের প্রাধান্য থাকে। নকশি হাঁড়ি, সরা, কুলা, চালুন ব্যবহার করে মঞ্চকে ঐতিহ্যিক একটা আবহ দেওয়া হয়। নাগরিক পরিমণ্ডলের লোকশিল্পের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে আলপনা, সরাচিত্র, মুখোশ, ফুল দিয়ে মেয়েদের কেশসজ্জা, গালে রঙিন অংকন প্রভৃতি অনেক বেশি আবেদন রাখে। সড়ক-রাস্তা, সাংস্কৃতিক মঞ্চ, এমনকি মুখমণ্ডলের বা বহুতেও নানা ধরনের বর্ণিল আলপনার উপস্থিতি লক্ষ করা যায় বাংলা নববর্ষে। মেয়েদের বৈশাখী শাড়ি ও ছেলেদের পাঞ্জাবির বর্ণিল বৈচিত্র্য থাকে নজরকাড়া। আর এসব লোকশিল্পের উপাদান স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সংযোজিত হয়ে গেছে বাংলা নববর্ষের সাথে।পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুন দিনের গৌরবে বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতিকে প্রতিদিনকার জীবন-যাপন থেকে মুক্তির বার্তা বয়ে আনে। বাংলা নববর্ষ তাই সত্য, মঙ্গল ও নির্ভিক মহত্ত্বের গৌরবে উদ্ভাসিত।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।